ক্ষুধা

ইরফান তানভীর | সোমবার , ২৮ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের বাইরের সারিসারি খাবারের দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। ছাত্রদের আজকাল হাতে টাকাপয়সার কমতি নেই বোধহয়। বাহারি খাবারের দোকানগুলোর চিত্র আমাকে তাই ভাবতে বাধ্য করছে। আমি কিছুটা ইতস্তত, ইতিউতি চেয়ে অগোছালো আর অপরিচ্ছন্ন একটি দোকানে গিয়ে দুটি সমুচার অর্ডার করি। পকেট থেকে খুচরা টাকাগুলো গুনে বিল পরিশোধ করে, সমুচার প্লেটটি নিয়ে শেষদিকের একটি টেবিলে বসতেই মনে হলো, আশপাশের ছেলেরা হরেকরকম বাহারি খাবারের ডালা বিছিয়ে বসেছে। কেউ কেউ বিরস মুখে খাচ্ছে, মুখে রুচছে না জেনেও চারপাশে পরিবেষ্টিত খাবারের আলিঙ্গন আমাকে একটু কাতর করে তুলল। না না, লিপ্সা, কিংবা এসব চোখধাঁধানো খাবারের আগ্রহে আমার জিভে জল এসেছে, ঘটনাটি এমন নয়। তাদের পকেট হয়ত কচকচে নোটে ভর্তি, তো তাদের একান্ত বিষয়। আমার মনোবেদনার কারণ ছিল অন্য জায়গায়।

.

আব্বা মারা গেলেন পনের কি ষোল দিন হলো। কোরবানির ঈদের তিনদিন আগে তিনি মারা গেলেন। আমি তখন ক্লাস নাইনে। উদ্যমতা ভরপুর এক কিশোর। ঈদের ছুটি শেষে মা আর বাড়িতে থাকতে দিলেন না। আব্বা মারা যাওয়ার শোক কাটিয়ে না উঠতেই, ছুটি শেষে আমি যথারীতি হোস্টেলে উঠে পড়লাম। ক্লাসে আসা যাওয়া করলেও আমার মনের উদ্যমতা কমে গেছে। আগের চঞ্চলতায় সূতা লেগে গিট্টু পেকে গেছে। বাড়ি থেকে এসে আমার পকেট শূন্য। এতে বিকেলের নাস্তাটা বাদ পড়ে গেল। ঠিক সেসময়টাতে হোস্টেল অফিস থেকে এক ফরমান জারি হলো বেতন বকেয়া ছাত্রদের। ঘোষণা এলো, ‘অতি সত্বর হোস্টেলের টাকা পরিশোধ করিতে হইবে, অন্যথায় আগামী ওয়াক্ত থেকে খাবারের মিল বন্ধ।’ এ ঘোষণা বেতন বকেয়া ছাত্রদের তেমন একটা বিচলিত করেছে বলে মনে হয় না। তারা অনেকাটা এ ফরমানকে উপভোগ্য বিষয় হিসেবে নিয়েছে। তাদের নির্ভার থাকার মূলসূত্র হচ্ছে, সবে বাড়ি থেকে আসায় তাদের পকেটে টাকাপয়সা কিছু আছে। তারা সিদ্বান্তও নেয়, বাড়িতে খবর জানিয়ে এখন থেকে বাইরের হোটেলে খাবে। কিছুটা বিপাক আর দুশ্চিন্তায় পড়তে হলো আমাকে। না আমার পকেটে আছে কোন টাকা, না অন্য উপায়। তবে বাড়িতে জানানোর উপায় তো ছিল। কিন্তু সে কিশোর বয়সেই আমার মনে হলো, বাড়িতে আমার হোস্টেল বকেয়ার কথা জানালে আমার মাই বা কোথা হতে টাকা জোগাড় করবেন। বা জোগাড় হয়ত করতে পারবেন, কিন্ত মাকে তো এক নতুন শোক আচ্ছন্ন করবে। বাবাহারা সন্তানের অনিশ্চিত খাবারের শোক! তিনি কী এই ভার নিতে পারতেন? তার ছেলের খাবার বন্ধ হয়ে গেছে ভেবে তিনি হয়ত একা বাড়িতে আবার মূর্চ্ছা যেতেন। মানুষে বোধ তৈরি হতে বোধহয় বয়সের অপেক্ষা করতে হয় না। পরিবেশ, পরিস্থিতি অনেক শিশুকেই বড় মানুষ বানিয়ে দেয়। আমি আমার মাকে আমার খাবার বন্ধের কথা জানাইনি।

.

যাত্রা শুরু হলো নতুন এক পথের। বুঝতে শুরু করলাম পৃথিবীর আদি ও আসল বাস্তবতা। সকালে ভাতের পাতিল চলে এসেছে রুমের সামনে। আমাদের পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাদের খাবার নেয়ার বিধান নেই। আমি বিব্রত পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে যাই। সারাদিন ক্লাস করে দুপুরে টিকে থাকাটা কষ্টকরই ছিলো কিছুটা। তখন নতুন এক ভাবনা উঁকি দিল মনে। দুপুরের সময় যে পাতিলগুলোতে করে খাবার আনা হতো রান্নাঘর থেকে, তা পড়ে থাকত সন্ধ্যা অবধি। এবং সেখানে কিছু বেচে যাওয়া ভাত তরকারিও থাকত। আমি বিকেলের শেষদিকে এসে পাতিলের কাছে এসে দেখি, সাদা ভাত আর পাতলা মশুর ডাল আমাকে মায়ের মমতা দিয়ে কাতর কন্ঠে ডাকছে, আয় আয় করে। বিব্রত বদনে, কিছুটা লজ্জা আর মৃদু শঙ্কায় আমি সেদিন প্লেট নিয়ে সে পাতিল থেকে পড়ে থাকা অবশিষ্ট ভাত আর ডাল খেয়েছি। গোগ্রাসে খাবার গিলতে গিয়ে আমার চোখের পানি ঠিক কয় ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল, বা আদৌ গড়িয়ে পড়ল কিনা তা আমার এখন মনে নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধনাটকের দর্শক ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা