আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান বাড়ছে। তাই এর উন্নয়নে একযোগে কাজ করার ওপর সরকার গুরুত্বারোপ করে চলেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হচ্ছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। এটি সমৃদ্ধ হলে অর্থনীতি টেকসই হবে এবং দেশের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকবে। তবেই বাংলাদেশ বিশ্বের বিস্ময় হবে। তাঁরা সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ২০৪১ এবং এসডিজি বাস্তবায়নে বেসরকারি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন এবং আর্থিক খাতের শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে এসএমই উদ্যোক্তাদের আরো বেশি সহযোগিতা করার আহবান জানান।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে সিএমএসএমই খাতের অবদান বৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রতিবছরই সিএমএসএমই খাতের অবদান বাড়ছে। অর্থনীতিতে গত ২০২২–২৩ অর্থবছর সিএমএসএমই খাতের মূল্য সংযোজন ছিল ৫ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২০–২১ অর্থবছর অর্থনীতিতে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এমএসএমই) মূল্য সংযোজন ছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। পরের বছর সেটি ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ২০২২–২৩ অর্থবছরে এমএসএমই খাতের মূল্য সংযোজন ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ বেড়ে ৩ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। একইভাবে গত অর্থবছর কুটির শিল্পের মূল্য সংযোজন সাড়ে ১৭ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিসিএসের তথ্যানুযায়ী, ২০২২–২৩ অর্থবছর জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২৩ দশমিক ১০ শতাংশ। এর মধ্যে বড় শিল্পের ১১ দশমিক ২০ শতাংশ, এমএসএমইর ৭ দশমিক ৩৫ এবং কুটির শিল্পের হিস্যা ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা কত তার সঠিক হিসাব নেই। ২০২০ সালে প্রকাশিত বিবিএসের উৎপাদন শিল্প জরিপ অনুযায়ী, দেশে ভারী শিল্পের সংখ্যা ২ হাজার ৮৫৬টি। আর অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এমএসএমই) কারখানার সংখ্যা প্রায় ৪৩ হাজার। তার মধ্যে অতি ক্ষুদ্র ১৬ হাজার ৭৭০টি, ছোট ২৩ হাজার ৩০৬টি ও মাঝারি কারখানা রয়েছে ৩ হাজার ১৭৮টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সার্বিকভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ খুব একটা ঘটেনি। বেশিরভাগ কর্মসংস্থানও তাদের এসএমই খাতে। সুতরাং বৃহৎ শিল্প বা বৃহৎ বাণিজ্যের অবদানকে আমরা যেভাবে বড় করে দেখি বা নির্ভর করি তা ভুল। আর বৃহৎ শিল্পের প্রতি সাধারণ ঝোঁকটা এসএমই খাতের প্রতি অবহেলাও একটা কারণ। বাংলাদেশে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ শ্রমিক এসএমই খাতে জড়িত। সুতরাং এসএমই খাত যত বড় হবে, কর্মসংস্থান পরিধিও তত বড় হবে। তারপরও আমরা যেভাবে এসএমই খাতকে অবহেলা করি, তা উন্নত দেশগুলো করে না।’
আসলে বড় বড় শিল্পের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খানিকটা নয়, অনেকটাই অবহেলিত। আমরা যে আর্থসামাজিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হতে পারে আমাদের বড় ভরসাস্থল, এক বিরাট চালিকাশক্তি। এসএমইতে আমরা কেন এত গুরুত্ব দেব? ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, গুরুত্ব দেওয়ার কারণগুলো হচ্ছে– প্রথমত, এসএমএই খাতে বর্তমানে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী জড়িত। দ্বিতীয়ত, এই খাতের দ্রুত বিকাশ লাভ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তৃতীয়ত, এসএমই খাতের পণ্য গুণে–মানে কোনো অংশেই কম নয়। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রযুক্তি নির্ভর। এ খাত আয়বর্ধক খাত হিসাবে চিহ্নিত। যারা চাকরি করতে চায় না বা করে না, শিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত–তাদের সবারই একটা সুযোগ থাকে এখানে কিছু করার। চতুর্থত, কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটা বড় সুযোগ ও ক্ষেত্র হচ্ছে এসএমই খাত। সার্বিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের বড় একটা হাতিয়ার এটা। আমাদের সর্বশেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও এই খাতের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাতটি বর্তমানে যেকোনো সময়ের তুলনায় মজবুত অবস্থায় রয়েছে। সিএমএসএমই উদ্যোক্তারা ক্ষতি কাটিয়ে ব্যবসায় ফিরে আসতে পেরেছেন। এই খাতের প্রত্যক্ষ অবদানে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে যত রকমের প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব, তা প্রদান করা জরুরি।