ক্ষতির মুখে ডিলার ডিস্ট্রিবিউটররা

এলপি গ্যাস নিয়ে নেই নীতিমালা

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৮ নভেম্বর, ২০২০ at ৪:৪১ পূর্বাহ্ণ

গৃহস্থলী কিংবা হোটেল রেস্তোরাঁয় খাবার রান্নায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বোতলজাত এলপি গ্যাস। বাড়তি চাহিদার কারণে সারাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় অর্ধ শতাধিক এলপিজি (লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) প্লান্ট। এসব প্লান্টে বিনিয়োগ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি নীতিমালার অভাবে মার খাচ্ছেন এ খাতে বিনিয়োগকারী ডিলার ডিস্ট্রিবিউটর ব্যবসায়ীরা। লোকসান গুণতে গিয়ে পথে বসছেন কোটিপতি ব্যবসায়ীরাও। ক্ষতিগ্রস্ত ডিস্ট্রিবিউটরদের অভিযোগ, বাজারে নতুন নতুন কোম্পানি আসছে। এতে বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। ফলে ব্যবসা ঠিকিয়ে রাখতে বেশি দামে কিনে প্রতিনিয়ত কম দামে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে লোকসান গুণতে হচ্ছে।
জানা যায়, গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের শুরুতে বোতলজাত গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে বিভিন্ন অপারেটর। চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন পুরোনো ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ওমেরা এলপি ডিস্ট্রিবিউটরদের ১২ কেজির বোতলের জন্য ৮৪৫ টাকার ডিমান্ড ড্রাফট (ডিডি) করতে হয়। ওই ৮৪৫ টাকা থেকে দুই সপ্তাহ পড়ে কমিশন হিসেবে ৪০ টাকা ফেরত পান সংশ্লিষ্ট ডিস্ট্রিবিউটর। একইভাবে বিএম এলপিজির জন্য ডিডি করতে হয় বোতলপ্রতি ৮৩০ টাকা। কমিশন ও গাড়িভাড়া মিলে ৬০-৮০ টাকা ফেরত পান ডিস্ট্রিবিউটররা। একইভাবে টোটাল গ্যাসের জন্য ডিডি করতে হয় ৮১৫ টাকা। কমিশন হিসেবে ফেরত আসে ৯-১৪ টাকা। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জোরারগঞ্জ, সীতাকুণ্ড ও বারৈয়ার হাট এলাকার প্লান্ট থেকে এসব এলপিজি বোতল সংগ্রহ করে গুদামজাত এবং নগরীর খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে ৪২-৫২ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে ডিস্ট্রিবিউটরদের। পরে বাজারে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পাইকারি দামে ওমেরা বিক্রি হয় ৭৮০ টাকা, বিএম ৭৬০ টাকা, টোটাল ৮০০-৮২০ টাকা। এতে একেকটি বোতল বিক্রিতে গড়ে ৪০-৫০টাকা লোকসান হচ্ছে বলে জানালেন ডিস্ট্রিবিউটররা। তবে বসুন্ধরা, সুপারসহ কয়েকটির দাম কম থাকলেও বাজারে সিলিন্ডার সংকট থাকার কথা বলছেন তারা। বর্তমানে বাজারে বসুন্ধরা, যমুনা, বিএম, ওমেরা, টোটাল, জি-গ্যাস, পেট্রোম্যাক্স, লাফস্‌, ইউনি গ্যাস, ডেল্টা, ফ্রেশ, জেএমআই, নাভানা, ওরিয়ন, বেক্সিমকো, সেনা, ইউনিভার্সাল, ইউরো, ইনডেক্স, বিন হাবিব, পদ্মা, প্রমিতা, নেওয়াজ, সুপার নামের প্রতিষ্ঠানগুলো এলপি গ্যাস বাজারজাত করছে বলে জানা যায়। বাকলিয়া এলাকার ওমেরা, বিএম, অরিয়নসহ বেশ কয়েকটি ব্রান্ডের ডিলারশিপ নিয়েছেন মোক্তার হোসেন লিটন। বাকলিয়ায় নাজিম উদ্দিন শাহ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে এলপিজি ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে এ ব্যবসায়ে জড়িত। তিনি বলেন, ‘প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অপারেটর বাজারে আসছে। নতুন নতুন ডিস্ট্রিবিউটর নিচ্ছেন তারা। এতে এ ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। প্রতি মাসে টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। আবার টার্গেট পূরণ করতে না পারলে ডিস্ট্রিবিউটরশিপ হারানোর হুমকি রয়েছে। মাসের পর মাস বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। কোটিপতি অনেক ডিস্ট্রিবিউটরও এখন পথে বসেছে।’
এব্যবসায়ী আরো বলেন, ‘এলপিজি বাজারজাতকরণের জন্য কোন নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। যে কারণে বোতলজাত এলপি গ্যাস ব্যবসায়ে এখন নৈরাজ্য চলছে। যে যার মতো করে বিক্রি করছে। এতে বিভিন্ন কোম্পানি ডিস্ট্রিবিউটররা মার খাচ্ছে।’
হালিশহর এলাকার সুপার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির স্বত্ত্বাধিকারী জহুরুল হক জম্মু দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কমিশন বাদ দিয়েও গাড়িভাড়া, গুদাম ভাড়া, স্টাফ খরচ মিলে আমার মাসে দেড় লাখ টাকা খরচ আসে। কিন্তু আয় হয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। গত দেড় বছর ধরে প্রতিমাসে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা লোকসান দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘ডিস্ট্রিবিউটর হতে গেলে অপারেটরগুলো থেকে বোতলগুলো কিনে নিতে হয়। বোতলগুলো কিনতেই অনেক টাকা বিনিয়োগ হয়ে গেছে। আমরা যখন ব্যবসা শুরু করি তখন একেকটি বোতলের দাম ছিল ২২শ টাকা। পরে ১৩শ টাকা হয়। বর্তমানে ৪শ টাকা। এখন ব্যবসা বন্ধ করতে গেলে বোতলের দামও উঠে আসবে না। তাই আবারো সুদিনের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু কতদিন লোকসান দিতে পারবো জানি না। ডিলার ডিস্ট্রিবিউটররা লোকসান দিলেও অপারেটর ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কোন লস নেই।’
আগে গাড়ির ব্যাটারি সরবরাহের ব্যবসা করতাম। তাতেই ভালভাবে জীবন চলছিল। গত ৬ বছর ধরে একটি এলপিজি কোম্পানির ডিলারশিপ নিয়েছি। প্রথমে ব্যবসা ভালো চললেও এখন অনেক কয়েক লক্ষ টাকা দেনায় পড়ে গেছি- জানালেন চকবাজার ও বাকলিয়া এলাকার রংধনু এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধীকারী মো. করিম। তিনি বলেন, ‘প্লান্ট থেকে সংগ্রহ করে বিক্রি পর্যন্ত একটি বোতলে ৪৫-৫২ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। সবমিলিয়ে প্রতিবোতল গ্যাসের জন্য খরচ পড়ে ৮০০-৮৫০ টাকা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৭৬০ থেকে ৮২০ টাকা। গত দুই মাসে বেশ কয়েকটি কোম্পানি তাদের গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। বাজারে নতুন নতুন কোম্পানি আসছে। ফলে নতুন নতুন ডিস্ট্রিবিউটর নিচ্ছেন তারা। এতে মাঠপর্যায়ে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। অনেকে অভিজ্ঞতা না নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ নিয়ে নতুন নতুন বিনিয়োগ করে বসছে। পরে ব্যবসায় এসে বিপাকে পড়ছেন।’ গত এক থেকে দেড় বছর ধরে টানা লোকসান দিচ্ছেন বলে জানালেন এ ব্যবসায়ী।
আরেক ডিস্ট্রিবিউটর শাহ মোহছেন আউলিয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী মো. কামাল ভুইয়া জানান, ‘এখন আমরা অনেক ক্ষতির শিকার হচ্ছি। কোম্পানি থেকে কিনে এনে প্রতিযোগিতার কারণে কমে বিক্রি করতে হচ্ছে। দিন দিন খারাপ হচ্ছে এ ব্যবসা। আমরা যখন ব্যবসা শুরু করি তখন হাতেগোনা ৪-৫টি কোম্পানি ছিল। এখন ২৯টির মতো কোম্পানি বাজারে আছে। আমার প্রতিমাসে ২০-৩০ হাজার টাকা লোকসান দিচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে।’
এলপিজি বোটলার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লাবাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পদ্মা এলপিজি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামীম চৌধুরী গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে যে পরিমাণ এলজিপি চাহিদা রয়েছে, তার চেয়ে বেশি উৎপাদন সক্ষমতার অপারেটর বাজারে এসেছে। বর্তমানে ৫৭টি কোম্পানিকে এলপিজি অপারেটর হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। বাজারে এসেছে ২৭টি কোম্পানি। অথচ এতবেশি অপারেটর বর্তমান সময়ে প্রয়োজনই ছিলো না।’
তিনি বলেন, বেশি অপারেটর বাজারে আসার কারণে প্রতিযোগিতা বেশি তৈরি হয়েছে। এতে ডিলার ডিস্ট্রিবিউটরা শুধু নয়, ছোট ছোট অপারেটরগুলোও লোকসান গুণছে। বড় অপারেটরগুলো সাময়িক বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারলেও ছোট ছোট অপারেটররা এখন থেকে লোকসান গুণতে শুরু করেছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে অনেক অপারেটর বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে ব্যাংক বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিলেটগামী তেলবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত
পরবর্তী নিবন্ধকমলা হ্যারিস প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট