টানা কয়েকদিন বানের পানিতে নিমজ্জিত থাকা চকরিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার, লামা, বান্দরবান, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বৃষ্টিপাত কমায় পানি কমতে শুরু করলেও এখনো পানির নিচে প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে কষ্টে পড়েছেন বানবাসী মানুষ। এদিকে চট্টগ্রাম থেকে এখনও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রায় সব বন্যা কবলিত এলাকার। বিশেষ করে সব উপজেলা এবং সারাদেশের সঙ্গে বান্দরবান জেলার সড়ক যোগাযোগ এখনো পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তবে আজ বৃহস্পতিবার থেকে চট্টগ্রাম–বান্দরবান কিছু দূরপাল্লার বাস চালুর কথা রয়েছে। আজ থেকে কক্সবাজার–চট্টগ্রাম রুটেও বাস চলাচল শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আমাদের জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন।
চকরিয়া : একটানা বর্ষণ ও পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে চকরিয়ায় তিনদিন ধরে ভাসতে থাকা মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে রেখে পানি নামতে শুরু করেছে ভাটির দিকে। তবে পানিতে এখনো ভাসছে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ৭০ শতাংশ এলাকা। উপজেলার অপেক্ষাকৃত উঁচু ইউনিয়নগুলো থেকে পানি নামার সাথে সাথে ভেসে উঠছে বন্যায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো। এখনো উপজেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় কোথায় কোন সড়কের কী অবস্থা তা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছে না সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।
এদিকে চকরিয়া–পেকুয়ার দুই উপজেলার ২৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার প্রায় তিন লাখেরও বেশি মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে দিনাতিপাত করছেন। কয়েকফুট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় গত তিনদিন ধরে বন্ধ রয়েছে দুই উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। জরুরি প্রয়োজনে মানুষ নৌকায় চেপে ও গাছ–বাঁশ ও কলাগাছের ভেলায় করে যাতায়াত করছেন। গত তিনদিন ধরে এসব মানুষ মানবেতর জীবন–যাপন করছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, গতকাল বুধবার ভোররাত থেকে চকরিয়া উপজেলার পূর্বাংশের অপেক্ষাকৃত উঁচু ইউনিয়নগুলোর পানি কিছুটা কমে আসলেও এখনো নিম্নাঞ্চলের হাজারো বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে রয়েছে। অপরদিকে পশ্চিমাংশের উপকূলীয় সাতটি ইউনিয়নের অবস্থা হয়েছে খুব খারাপ। কারণ ভাটির দিকের এসব ইউনিয়নের লোকালয় নতুন করে বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় রান্নাবান্না করতে না পারায় তীব্র খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছেন উপকূলীয় এলাকার লক্ষাধিক মানুষ।
স্মরণকালের এবারের ভয়াবহ বন্যায় চকরিয়ায় গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত সাতজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তদ্মধ্যে বাড়ির ওপর পাহাড় ধসে দুই শিশু, পানির তীব্র স্রোতে ভেসে গিয়ে আরও পাঁচজন মারা যায়। সেই পাঁচজনের মধ্যে নিখোঁজ দুইজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে গতকাল। এখনো নিখোঁজ রয়েছে অপর এক শিশু।
সরেজমিন ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো কোনো ইউনিয়নে সড়ক ও বেড়িবাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে গেছে দুই উপজেলার দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভেসে গেছে ৪০ হাজার একরের চিংড়ি ও মৎস্যজোন, পাঁচ শতাধিক পুকুরের মাছ, তলিয়ে গেছে দুই উপজেলার ৭০ হাজার একর জমিতে রোপিত আমন ধান ও রকমারি সবজি ক্ষেত। তার ওপর বর্ষণ অব্যাহত থাকায় দুই উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কক্সবাজার : কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় গতকাল বুধবার সকাল থেকে কক্সবাজার–টেকনাফ মহাসড়কে যান চলাচল পুনরায় শুরু হয়েছে। তবে কক্সবাজার–চট্টগ্রাম মহাসড়কের কয়েকটি স্থান এখনও পানির নিচে থাকায় এ সড়কে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল এখনও শুরু হয়নি। পানি নেমে গেলে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এ সড়কেও পুনরায় যান চলাচল শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কক্সবাজারে গত দুইদিন ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে এবং নিম্নাঞ্চলে আটকে থাকা ঢলের পানি নেমে যাচ্ছে। ফলে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া অধিকাংশ মানুষই তাদের বাড়িঘরে ফিরে গেছে। গত দুইদিন কক্সবাজারে ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় নিম্নাঞ্চলে আটকে পড়া ঢলের পানি নেমে যাচ্ছে এবং আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া লোকজনও তাদের বাড়িঘরে ফিরে যাচ্ছে বলে জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ। তিনি জানান, বন্যায় কক্সবাজার জেলার ৬০ ইউনিয়নের তিন লক্ষাধিক মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। এরমধ্যে দুর্গত মানুষদের জন্য খুলে দেয়া ২০৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ আশ্রয় নেন। কিন্তু বুধবার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রিত লোকজন তাদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেন।
কক্সবাজার বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি রফিকুল হুদা চৌধুরী জানান, কক্সবাজার–টেকনাফ সড়কের রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের কাড়ির মাথা, চেইন্দা ও পানেরছড়া এলাকার বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় বুধবার সকাল থেকেই এই সড়কে যান বাহন চলাচল শুরু হয়। তবে কক্সবাজার–চট্টগ্রাম মহাসড়কের কয়েকটি স্থান এখনও পানির নিচে থাকায় এ সড়কে দুরপাল্লার যানবাহন চলাচল এখনও শুরু হয়নি। অবশ্য দুপুরের পর থেকে কিছু কিছু যানবাহন চকরিয়া–বাঁশখালী–আনোয়ারা সড়ক হয়ে চট্টগ্রামে যাতায়াত করে বলে জানা যায়। পানি নেমে গেলে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কক্সবাজার–চট্টগ্রাম–ঢাকা মহাসড়কেও পুনরায় দুরপাল্লার যান চলাচল শুরু হবে বলে জানান কক্সবাজারস্থ এস আলম পরিবহনের ইনচার্জ নুরুল আলম।
বান্দরবান : বান্দরবানে বৃষ্টিপাত কমায় চারদিন পর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে সব উপজেলা এবং সারাদেশের সাথে বান্দরবান জেলার সড়ক যোগাযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টির পর বান্দরবানের আকাশে ঝলমলে রোদ উঠেছে। তবে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে পুরো জেলা। মানুষ বিদ্যুতের জন্য অধীর অপেক্ষায় রয়েছে। বিদ্যুৎ কার্যালয়ে কর্মরত মো. নাছির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, প্রকৌশলীরা সকাল থেকে যার যার লাইনে গেছে। বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন তদারকি করছেন। এখানে মেইন ট্রান্সফরমার পানির নিচে ছিল। সারিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে।
জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা জানায়, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ছয়দিন পর বান্দরবান জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। অধিকাংশ প্লাবিত এলাকা ও সড়ক থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। তবে বান্দরবান–কেরানীহাট–চট্টগ্রাম মহাসড়কের হলুদিয়া, বায়তুলইজ্জত এলাকায় সড়কে পানি উঠায় সারাদেশের সাথে বান্দরবান জেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে তিনদিন ধরে। বান্দরবান বাস স্টেশন থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। যাত্রীদের অটোরিকশায় করে চট্টগ্রামের কেরানীহাটের বড়দুয়ার পর্যন্ত যেতে দেখা গেছে। বান্দরবান–রোয়াংছড়ি সড়কের কালাঘাটা এলাকায় জমে থাকা বুকসমান পানিতে নৌকায় ও হেঁটে পারাপার হচ্ছেন স্থানীয়রা।
বাস স্টেশনের সিএনজি চালক মো. মামুন বলেন, বান্দরবান থেকে ঢাকা–চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে কেরানীহাট সড়কের এখনও কোথায় হাঁটু সমান আবার কোথায় বুকসমান পানি রয়েছে। জরুরি কাজের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছেন যাত্রীরা।
লামা : লামায় পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ফলে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে নিজ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে বন্যার্ত সাধারণ মানুষ। উপজেলার শতাধিক স্থানে পাহাড় ধসে শত শত ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বন্যা কববলিত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পুরো উপজেলায় হাজার হাজার ঘর–বাড়ি, জমির ফসল, অসংখ্য মংস্য খামার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি লামা বাজারের ব্যবসায়ীদের অর্ধ শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন।
রোববার সকাল থেকে বন্যা কবলিত হওয়ার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে পানি কমতে শুরু করলে বুধবার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। বন্যার পানি কমার সাথে সাথে লামা পৌরসভার পক্ষ থেকে দ্রুত লামা বাজার পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
সাতকানিয়া লোহাগাড়া চন্দনাইশ : কয়েক দিন ভুগিয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলায় বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে; তবে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে কষ্টে পড়েছেন বানবাসী মানুষ। পাশাপাশি কয়েক লাখ বাসিন্দাদের দিন–রাত কাটছে বিদ্যুৎহীন, যা ভোগান্তির মাত্রা বাড়িয়েছে। এতে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ না করায় যোগাযোগবিহীন হয়ে পড়েছেন বেশির ভাগই।
টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের হঠাৎ এ বন্যায় সবমিলে দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন মানুষজন। সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এমএ মোতালেব এ পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে, বিদ্যুৎ নাই, খাবার পানি নাই– ভয়াবহ দুর্ভোগে আছে সাতকানিয়ার মানুষ। তিনি বলেন, সব জায়গায় পানি… বাজার সদায় করতে পারছে না। খাবারের অভাব। শুকনো খাবার বিতরণ করা হলেও সরকারিভাবে এখনও বরাদ্দ আসেনি। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে কথাও বলেছি।
বিডিনিউজ জানায়, দুর্যোগের মধ্যে বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকার কথা জানিয়ে চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার জানান, সাতাকানিয়া–লোহাগাড়ার ২৫টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভার তিন লাখ ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় তথ্য জানতে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।












