আমাদের তারুণ্যের সোনালি সময়গুলি কেটেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে ইউরোপের ভালো ভালো সব সিনেমা দেখে। সবগুলিই যে ক্লাসিক ছবি ছিল তা নয়, মূলধারার অনেক শিল্পসম্মত ছবিও দেখার সুযোগ হতো। চট্টগ্রামের বিশেষায়িত তিনটি প্রেক্ষাগৃহ দিনার, মেলোডি ও রিদমে এসব ছবি দেখতাম। তবে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে দেখার সুযোগ চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। এখানে ফরাসি ছবি ছাড়াও ইউরোপ এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রও প্রদর্শন করা হতো। এখানেই প্রথম দেখি ক্লদিয়া কার্দিনেল অভিনীত ছবি। ছবিটির নাম এখনও মনে আছে, দি পিওক পান্থার। ব্লেইক এডওয়ার্ডস পরিচালিত ছবিটি ছিল ফ্রান্স, ইতালি ও হলিউডের যৌথ প্রযোজনা। ক্লাদিয়ার সঙ্গে এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন পিটার সেলার্স, ডেভিড নিভেন, ক্যাপুসিনে। খুব সম্ভবত ১৯৭১ সালে দেখেছিলাম ছবিটি আলিয়ঁসে। পরে এই ছবিটি সিনেমা হলেও দেখেছি। প্রথম থেকেই অনিন্দ্যসুন্দর রূপ এবং অনবদ্য অভিনয়ের কারণে ক্লদিয়ার অনুরাগী ছিলাম। পরবর্তী সময়ে উনার আরও ছবি দেখার সুযোগ পাই এবং এক মায়াবী মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি, যে মোহে ভালোবাসার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল শ্রদ্ধা।
ক্লদিয়া কার্ফিনেল ১৭৫ টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন যার মধ্যে বেশ কিছু টেলিফিল্মও রয়েছে। মূলত মূলধারার ছবিতে পেশাগত প্রয়োজনে অভিনয় করলেও ফেদেরিকো ফেলিনি, আলবার্তো কাভালকান্তি আবেল গাঁস, মারিও মনিচেল্লি, ফ্রাংকো রসি, জোসে জিওভানি, আলবার্তো মোর্দি, লুসিনো ভিসকান্তি, কার্লো ডি পালমা, সার্জিও লিঁও, ওয়ার্নার হারজগ, ক্লদ লেলুশ প্রমুখ ইউরোপীয় শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্রকারদের দুনিয়া কাঁপানো ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রে তিনি তাঁর সম্মানের আসনটি পোক্ত করে নিতে পেরেছিলেন। জাতিগতভাবে ইতালীয় হলেও তাঁর জন্ম তৎকালীন ফরাসি শাসনাধীন তিউনিসিয়ায় ১৯৩৮ সালে। ‘ইতালিয়ান স্ক্রিন কুইন’ নামে খ্যাত ক্লদিয়া ইতালি ও ফ্রান্স দুই দেশেই বসবাস করেছেন এবং অভিনয় করেছেন এই দুই দেশের সিনেমাসহ তিউনিশিয়া, হলিউড ও জার্মানির চলচ্চিত্রে। প্রয়াত হয়েছেন কয়েকদিন আগে, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে ফ্রান্সের নেমার শহরে ৮৭ বছর বয়সে। এইসব সূত্রে ক্লাদিয়াকে বিশ্বনাগরিক বলা যেতেই পারে।
ক্লদিয়ার প্রথম অভিনয় ১৯৫৮ সালে জ্যাক ব্যারাটিয়ার পরিচালিত ফ্রান্স–তিউনিশিয়া–ইতালির যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘গোহা’তে আরবী রমনী আমিনার চরিত্রে। তবে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন ঐ বছরেই দ্বিতীয় ছবি মারিও মনিচৌল্ল পরিচালিত ‘বিগ ডিল অন ম্যাডোনা স্ট্রিট’–এর মাধ্যমে। এ ছবিতে তিনি এক লাস্যময়ী তরুণী ক্যামেলিনার চরিত্রে আকর্ষণীয় অভিনয় উপহার দেন। এই চরিত্রে তিনি গ্ল্যামার এবং ইনটেলেকচুয়ালিটির সমন্বয়ে একটি অনবদ্য ঘরানা তৈরি করেন যা তিনি ক্রমশ তার অভিনয়ের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য পরিণত করে তোলেন। পরবর্তী সময়ে ক্লদিয়ার এই বৈশিষ্ট্য বিশ্বচলচ্চিত্রের আরও অনেক অভিনেত্রী অনুসরণ করে গেছেন।

ক্লদিয়া কার্দিনেল যখন অভিনয়ে আসেন এবং অভিনয় করতে থাকেন তখন ইতালির মনিকা ভিত্তি, জুলিয়েত্তা মাসানি, জিনা লোলো ব্রিজিদা, সোফিয়া লোরেন; ফ্রান্সের ব্রিজিত বার্দো, ক্যাথরিন দানিয়ব, জান মরো; জার্মানির রোমি শ্লাইডার রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দুনিয়া জুড়ে। ইউরোপের অভিনেত্রীদের রমরমা এই সময়ে ক্লদিয়াকে দস্তুর মতো তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে স্বীয় আসন অর্জন করে নিতে হয়েছে। এবং তা করে নিতে তিনি সমর্থ হয়েছিলেন নিজের ব্যতিক্রমধর্মী রূপলাবণ্য এবং অভিনয় মাধুর্যে। তিনি ছিলেন স্তানিশ্লাভস্কি স্কুলিং–এর অভিনয়শিল্পী যা সম্পূর্ণতেই মেথড অ্যাকটিং ঘরানার। এই অভিনয়ধারার চূড়ান্ত প্রয়োগ দেখা গেছে। ফেদেরিকো ফেলিনির এইট এন্ড হাফ; আবেল গাঁসের অস্টারলিৎজ; লুসিনো ভিসকান্তির বোকো এন্ড হিজ ব্রাদার্স, লিওপার্ড, কনভারসেশন পিস, সান্দ্রা; আলবার্তো কাভালকান্তির ভেনেটিয়ান হানিমুন; মিখাইল কালাতোজোভের দি রেড টেন্ট; ওয়ার্নার হারজগের ফিৎজেরাল্ডো প্রভৃতি ছবিতে। বিশেষ করে এইট এন্ড হাফ ছবিতে মার্সোল্লো মাস্ত্রোইয়ান্নি, দি রেড টেন্ট ছবিতে শন কোনারি, ভেনেটিয়ান হানিমুন ছবিতে ভিত্তোরিও ডে সিকা; ফিৎজেরাল্ডো ছবিতে ক্লদ কিনস্কির সঙ্গে ক্লাদিয়ার দুর্দান্ত অভিনয় বিশ্বচলচ্চিত্রে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
ক্লদিয়া ১০৩ টি ফিচার ফিল্ম, ৮টি টেলিভিশন ফিল্ম, ৮টি টিভি সিরিজ এবং ২৬ টি ডকুমেন্টরি ফিল্ম এবং ৩০ টি শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছেন। দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ভিশুয়াল মাধ্যমকে তিনি সমান গুরুত্ব দিয়েছেন যা তাঁর অভিনয় শৈলীকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। জীবনের প্রায় শেষ দিক পর্যন্ত তিনি অভিনয়ে সংযুক্ত ছিলেন। ২০২২ সালে তাঁর অভিনয় রাইদা বেহি পরিচালিত ‘দি আইল্যান্ড অফ ফরগিভনেস’ ছবিতে আগোস্তিনা চরিত্রে। জীবনের শেষ কয়েকটি বছর বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন।
ক্লদিয়ার জন্ম তিউনিশিয়ার রাজধানী তিউনিসের গলেতে ১৯৩৮ সালের ১৫ এপ্রিল। দেশটি তখন ফরাসি উপনিবেশ। ফলে জাতিগতভাবে ইতালীয় হলেও তাঁর বেড়ে ওঠা ফরাসি পরিমন্ডলে। আরবি, ফরাসি, ইংরেজি এবং মাতৃভাষা ইতালিয়ানে সমান দক্ষতা ছিল ক্লদিয়ার। বেশ কয়েকটি আরবী ভাষার ছবিতে অভিনয় করেছেন যেগুলো তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া ও মিশরের তৈরি। ক্লদিয়ার পুরো নাম ক্লদিয়া জোসেফিল রোজ কার্দিনেল। ১৯৬০ সালে তাঁকে ‘দি মোস্ট বিউটিফুল ওমেন ইন দি ওয়ার্ল্ড’ অভিধায় ভূষিত কবেন সে সময়ের চলচ্চিত্র সমালোচকেরা। ডাক নাম রোজ। পিতা ফ্রান্সসেসকো কার্দিনেল ছিলেন তিউনিশিয়ান রেলওয়ের কর্মকর্তা। মা ইয়োলানদো গ্রেসো ছিলেন সংস্কৃতিপ্রেমী। পিতামাতা ইতালিয়ান হলেও কর্মসূত্রে তাঁরা লে গলেতেই বসবাস করতেন।
শৈশবে রোজ ফরাসি ভাষাতেই ঘরে বাইরে কথা বলতেন। ইতালিতে ফেরার পর মাতৃভাষায় সাবলীল হয়ে ওঠেন। অভিনেতা অ্যালাঁ দেলোঁ, মার্লোন ব্র্যান্ডো এবং রবার্ট ডি নিরোর সঙ্গে গভীর প্রণয়ে যুক্ত থাকলেও কোনো সম্পর্কই পরিণয়ে পরিণতি পায়নি। ১৯৬৬ সালে ইতালির সিনেমার প্রখ্যাত প্রযোজক ফ্রাংকো ক্রিস্তালদির সঙ্গে ক্লদিয়া পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন যা অব্যাহত ছিল ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এই দম্পতির একপুত্র প্যাট্রিক ও ক্লদিয়া স্কুইতিয়েরি। ফ্রাংকোর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বাকি দীর্ঘ জীবনে ক্লদিয়া আর বিয়ে করেননি।
ইতালি ও ফ্রান্সে সমানভাবে বসবাস করলেও জন্মভূমি তিউনিসিয়ার প্রতি গভীর মমত্ববোধ ছিল তাঁর। আরবি ভাষায় দক্ষতার কারণে অনেকে তাঁকে আরবীয় বলেও ভাবতেন। অভিনয়সূত্রে হলিউডে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করলেও সেখানে স্থিত না হয়ে ফিরে আসেন প্রিয় কর্মভূমি ইতালিতে। কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় সেখানে কাটালেও শেষ জীবনে স্থিত হন ফ্রান্সে। ২০২৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের নেমারে ক্লদিয়ার প্রয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্বচলচ্চিত্রের আকাশের উজ্জ্বলতম আরও একটি নক্ষত্রের বিদায় ঘটলো আকাশটাকে আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে। কারণ আর দুয়েকটি মাত্র তারা মিটিমিটি জ্বলছে।











