দৈনিক আজাদীতে ২০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি সংবাদ পাঠক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। সেটি হলো : ‘দুই কেজির ইলিশ কখন তিন কেজি হয়’। দুই কেজি ওজনের ইলিশকে তিন কেজি বলে বিক্রি করে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। সংবাদে বলা হয়, দুই কেজি ওজনের ইলিশকে তিন কেজি বলে বিক্রি করায় নগরীতে এক মাছ বিক্রেতাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। নগরীর পাহাড়তলী বাজারে শাহীন সওদাগর নামে এক মাছ বিক্রেতাকে জরিমানাসহ সতর্ক করা হয়। গত শনিবার এবিপিএন-৯ এর সহায়তায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার তদারকির এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। সংবাদে বলা হয়, বাজার করতে আসা একজন ক্রেতাকে ৩ কেজি বলে ২ কেজি ইলিশ মাছ গছিয়ে দেন বিক্রেতা। কারচুপির মাধ্যমে ১ কেজি মাছ কম দেওয়ায় শাহীন সওদাগরকে ১০ হাজার টাকা জরিমানাসহ সতর্ক করা হয়।
এ কথা সত্যি যে, ব্যবসায়ীরা সবসময়ই লাভ বা মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবসা করেন। যে কোনো ব্যবসায়ী যুক্তিসঙ্গত মুনাফা বা লাভের বিনিময়ে, ক্রেতার স্বার্থের হানি না ঘটিয়ে যদি ব্যবসা করেন সে ক্ষেত্রে একজন ক্রেতার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশে ব্যবসায়ীসহ একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজমান। এ কারণে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী আছেন যারা সততা এবং কোনো ধরনের নীতিনৈতিকতার বালাই না করে বিভিন্ন অসাধু পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ভোক্তাদের ঠকিয়ে যাচ্ছেন। এসব অসাধু কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বিক্রি, মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর এমন দ্রব্য মিশিয়ে পণ্য বিক্রি, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, নকল পণ্য বিক্রি, ওজন বা মাপে কম দেয়া প্রভৃতি।
জানা যায়, ১৯৬০ সালের আগে পর্যন্ত সারা বিশ্বে এমনকি আমেরিকাতেও পণ্য বিপণনে ছিল সীমাহীন প্রতারণা, পণ্যে ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, ভেজাল। পণ্যের দেয়া হতো না বিশদ কোন তথ্য। ফলে ব্যবসায়ীদের গড়ে উঠেছিল একচেটিয়া কারবার। তারা তাদের খেয়াল খুশি মতো ভেজাল জাতীয় পণ্য বাজারজাত করতো। অপরদিকে ক্রেতারা ছিল অনেকাংশে তাদেরই কাছে জিম্মি। এসব অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ক্রেতারা সোচ্চার হতে থাকে। গড়ে ওঠতে থাকে নানাবিধ আন্দোলন। প্রতারিত ভোক্তা ক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণে উদ্ভব হয় ভোক্তাবাদ বা কনজুমারিজম। এরূপ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে হেগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের ক্রেতা সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সভায় গঠিত হয় আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংগঠন (আইওসিইউ)। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ক্রেতার ৪টি অধিকার সম্মিলিত এক ঘোষণা দেন, যার ঐতিহাসিক বিল মার্কিন কংগ্রেসে অনুমোদিত হয়। ক্রেতা অধিকার সংরক্ষণের এই আনুষ্ঠানিক যাত্রার পরিপূর্ণতা অর্জিত হয় ১৯৮৫ সালে। মূলত ১৯৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবে কার্যকরভাবে ক্রেতা সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ৭টি মূলনীতি গ্রহণ এবং সকল সদস্য রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের সকল সংগঠনকে ক্রেতাস্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়নের অনুরোধ জানানো হয়। আর জন এফ কেনেডির ক্রেতা অধিকার ঘোষণার দিন ১৫ মার্চ পালিত হয় ‘বিশ্ব ক্রেতা অধিকার দিবস’ হিসেবে।
আমাদের দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য ভোক্তাদের পক্ষ থেকে দীর্ঘ দিন দাবি করা হলেও শেষ অবধি ২০০৯ সালে আইনটি প্রণীত হয়। পরবর্তী প্রায় দশ -এগার বছর অতিবাহিত হতে চললেও এ আইনটির বিষয়ে ভোক্তাদের স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণে তারা এর সুফল থেকে বঞ্চিত।
মনে রাখতে হবে, ক্রেতার অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার। সকল মানুষ-ই ভোক্তা, সকলেই ক্রেতা। এই অধিকার সর্বজনীন। এই অধিকার প্রতিষ্ঠা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করা ও ভেজাল বা প্রতারণা থেকে মুক্ত থেকে ক্রেতার স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে আরো তৎপর হতে হবে।