প্রত্যেকটি ক্রসফায়ারের পর স্বজনদের ছবি ভেসে আসে টিভির পর্দায়। তাদের একমাত্র দাবী আর যেন কোন মায়ের কোল খালি না হয়। অথচ বেগম জিয়ার ক্লিন হার্ট থেকে সেই যে শুরু হয়েছে আজো তা চলছে। এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলা হয়, অস্ত্র উদ্ধারে গেলে চতুর্দিক থেকে আসামীর লোকজন ঘিরে ফেলেছিল। উভয় পক্ষের গোলাগুলি চলে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে পুলিশের গাড়িতে থাকা আসামী গুলিবিদ্ধ হয় এবং হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যায়। এই নিত্য বয়ানের ব্যতিক্রম ঘটে কক্সবাজারের কাউন্সিলর আকরাম হোসেন ক্রস ফায়ারের ক্ষেত্রে। মৃত্যুজঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার আগে র্যাব অফিসে বসা অবস্থাতেই মেয়ের সাথে মোবাইলে আকরামের কথোপকথন তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়লে শুরু হয় তোলপাড়। এরপরও র্যাব পুলিশ থামেনি। কিছু সময়ের ব্যবধানে আকরামকে ক্রসে দেয়া হয়। মাদক বিরোধী অভিযানের প্রেক্ষাপটে কক্সবাজারসহ গোটা দেশ জুড়ে তখন ক্রসফায়ারের মহোৎসব। সুতরাং চর্চিত কাহিনীগুলোর অবতারণা করা হয়নি, জেনারেল মঞ্জুরকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যার যে বর্ণনা মেজর এমদাদ আদালতে দিয়েছেন, কাউন্সিলর একরামকেও ঠিক সেভাবে দাঁড় করানো হয়। অতপর গুলি আর প্রকৃতির নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে মাটির বিছানায় শুয়ে পড়া। ধীরে ধীরে দৃষ্টি থেকে অপসৃত হয় তার দুটো রাজকন্যাসম মেয়ের মুখচ্ছবি। মেজর সিন্হা মোহাম্মদ রাশেদের হত্যাকাণ্ডটিতো আরো নৃশংসতায় ভরপুর। কোন সাধারণ অপরাধী বা নাগরিক তিনি ছিলেন না। সিন্হাকে দেখেই এসআই লিয়াকতের বুঝা উচিত ছিল, এ যে দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, তাকে সম্মান করে কথা বলতে হবে। কিছু জানার থাকলে থানায় নেয়া যেত। কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে সোজা গুলি। বেশী হৃদয় বিদারক হলো সিন্হা অক্সিজেন অক্সিজেন বলে আকুতি করেছে। দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে একটি মায়ের কোল শূন্য হতো না। গত কিছুদিন ধরে ক্রসফায়ার থেমে গেছে। কিন্তু সিন্হার ঘটনাই কি শেষ ক্রসফায়ার? অনেকে তেমন প্রত্যাশা করছেন। তেমন প্রত্যাশা আমারও। কিন্তু মনে হয় না এটি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। উপমহাদেশে ক্রসফায়ারের ইতিহাস বেশ পুরনো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে আর্মিই ক্রসফায়ারে হত্যা করেছিল। উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের পেছনে তার মৃত্যুর বিশাল ভূমিকা ছিল। একাত্তরে পাকিরা গোটা জাতিকেই ক্রসফায়ারে দিয়েছিল। অথচ আমরা সম্পূর্ণ সাময়িক প্রয়োজনীয়তায় দখলদার বাহিনীকে মোকাবেলা করেছি। স্বাধীনতা উত্তর কালে চীনপন্থী চরমপন্থীদের ক্রসফায়ারে দেয়ার অভিযোগ আছে। মাওপন্থীদের হাতে সংসদ সদস্য সহ অনেককে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ আছে। ভারতবর্ষে শ্রেণী শত্রু খতমের নামে অনেক নিরীহ মানুষকে নকশালপন্থীরা ক্রসফায়ারে হত্যা করেছিল। ঐসময় ইন্দিরা আর সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সরকারি বাহিনীর হাতে শত শত চারু মজুমদারপন্থিদের ক্রস ফায়ারে দেয়া হয়েছে। ২০০১ সালে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। বিএনপি জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার সন্ত্রাসীদের দমনের বিকল্প খুঁজতে থাকে। এই সময়কালে ঝাপটাবাজ, অস্ত্রবাজ, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজদের ধরে জেলে পুরে সমাধান হচ্ছিল না। এরা আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হয়ে আবার জড়িয়ে পড়ছিল অপরাধে। রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ও মাওপন্থীদের আইনের আওতায় এনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছিল। গোটা জাতি উপলব্ধি করল দু’শো বছরের পুরনো বৃটিশ আইনের এমন অনেক দুর্বলতা রয়েছে, যার চূড়ান্ত প্রয়োগ যেমন কঠিন তেমনি অপরাধীদের দমন তারচেয়ে অধিকতর কঠিন। এ সমস্যার ত্বরিৎ সমাধানে বেগম জিয়ার সরকার অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে শুরু করে সাঁড়াশি অভিযান। এই কাজটিতে বিএনপি পরিচয় দেয়া অস্ত্রবাজ চাঁদাবাজদের ক্রসে দেয়া হয়েছে বেশি। গোটা জাতি উল্লসিত হয়েছে। বেগম জিয়া প্রশংসিত হয়েছেন। ঐ একটি কাজের জন্য তিনি আজও প্রশংসিত।
আমরা দেখলাম জনতার মানসিকতাই ক্রসফায়ার বিস্তৃতির সহায়ক হয়েছে। বিচার বহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সম্মতি সাম্প্রতিককালের নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্য বহুলাংশে দায়ী। এখন একতরফা সরকারী বাহিনীকে দোষারোপ করা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে সরকারি বাহিনী ভাল মন্দ বিচার করছেন না, রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন। নানা ধরনের লাভ লোকসানের হিসেব মেলাতেও ক্রসফায়ার পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কাউন্সিলর আকরাম আর মেজর সিন্হা হত্যায় দেখলাম সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হাতে বন্দুকের শক্তিতে অতিউৎসাহী হয়ে গুলি চালিয়েছে। বন্দুকধারীদের নিয়ন্ত্রণের জন্যই বিচার বিভাগের নিকট জবাবদিহির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সুচিন্তিতভাবে র্যাব সৃষ্টির পর থেকে দেখা যাচ্ছে, বাহিনীটি নিজেদের কোর্টের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূতই মনে করেছে। নারায়ণগঞ্জের কমিশনার নজরুল, এডভোকেট চন্দন সহ ৯ জনকে র্যাব নৃশংসভাবে হত্যা করে নিষ্ঠুরতম পন্থায়। আমার মনে হয় র্যাবের সাংগঠনিক কাঠামোতে ম্যাজিস্ট্রেট পদায়নের সময় এসছে। প্রত্যেকটি অপারেশনে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করে আইন সংশোধন করা জরুরি। ম্যাজিস্ট্রেটের লিখিত অনুমতি ছাড়া কোন অপারেশন যাতে আর পরিচালিত না হয়। দেশের বহু প্রতিশ্রুতিশীল সন্তানকে হারিয়েছি, আর নিঃস্ব হতে চাই না।
অপরাধীকে কারাগারে ধরে রাখার ব্যর্থতা, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারে অহেতুক বিলম্ব ক্রসফায়ার গ্রহণযোগ্য হওয়ার মূল ভিত্তি। এখন জাতীয়ভাবেই এই তিনটি জায়গায় আইনকে অধিকতর আধুনিকায়ন করা দরকার। আইন কমিশনকে সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা নিতে হবে যেন প্রকৃত অপরাধী স্বল্প বা মধ্য মেয়াদে কারাগার থেকে বেরুবার পথ বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে সন্ত্রাসী ও মাদক সংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে।
গোটা দেশের ইয়াবা সহ অন্য মাদকগুলোর মূল কারবারী বড় জোর শ’খানেক। এদের স্পর্শ করার সাধ্য কারো নাই। এরা রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট। এসব মাদক সন্ত্রাসীরা আজ যদি শপথ নেয় তবে কাল থেকে মাদক ব্যবসা বন্ধ হতে বাধ্য। গ্রামে গিয়ে দেখলাম গাছ,বালি, গ্যাস সিলিন্ডার, দালান নির্মাণ, পুল সড়ক নির্মাণ, সংস্কারের মূল নিয়ন্ত্রক সরকার দলীয় কর্মীরা। এদের ছাড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে একটি ইট গাথার সাধ্য কারো নেই। এই রাজনৈতিক কর্মীরা আজ একেকজন গ্রামীণ নেতৃত্বে আসীন। এদের আজ আর কেউ সন্ত্রাসী বলার সাহস রাখে না। এদের ধরার সাহস পুলিশ র্যাব কারো নেই। এবার ভাবুন, আহত নাগরিক মাত্রই ক্ষোভে ফুঁসছে। বর্তমান সরকার বা ভবিষ্যৎ কোন সরকারের হাতে এদের ক্রস ফায়ারের মৃত্যু ছাড়া জনগণের মস্তিষ্কে বিকল্প কামনা নেই। এজন্যই বলছিলাম, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণেই নাগরিকগণ ক্রস ফায়ারের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। এখনো ক্রসফায়ার প্রত্যাশা করছেন।
সুতরাং যারা বলছেন, মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ’ই শেষ ক্রস ফায়ার, আমি তাদের সাথে মোটেও একমত নই। ক্রসফায়ার ধারণার মূল উর্বর ভূমি সমাজ ব্যবস্থা। সমাজ ব্যবস্থার গভীরে পরিবর্তন আনতে হলে, আইনী সংস্কার জরুরি। এটি জাতীয় ঐক্যমতের বিষয় এমন কোন গ্রহণযোগ্য পন্থা উদ্ভাবন করতে হবে যেন, যারা ক্ষমতায় যাবেন তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে। সন্ত্রাসী বা মাদক কারবারী যেন পরিষ্কার ধারণায় থাকে যে, ধরা পড়লে সারাজীবন হাজত খাটা ছাড়া বিকল্প নেই। জনগণও যেন আশ্বস্ত হয় যে, আইনের শাসনের কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। মনে রাখতে হবে বন্দুকের জোরে যুদ্ধে জেতা যায়। বন্দুকের ভয় দেখিয়ে অনেক দিন দেশ শাসন করা যায়। বন্দুকের জোরে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ গঠন করা যায় না।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট