বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) চলতি মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের খাবার কেনার খরচ ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালে মাথাপিছু খরচ ছিল ১ হাজার ৮৫১ টাকা, গত ফেব্রুয়ারিতে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯২৩ টাকায়। সেই তুলনায় মানুষের আয় কি বেড়েছে? যদি না বাড়ে, তাহলে তাঁরা এই ঘাটতি কীভাবে মেটান? প্রথমত, সংসারের অন্যান্য খরচ কমিয়ে। কেউ কেউ সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ করে কাজে লাগিয়ে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করেন। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ মানুষ খাদ্যঝুঁকিতে ছিল; যা এর আগের মাসের তুলনায় ২ শতাংশ বেড়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আর ৪৩ শতাংশ মানুষ বাকিতে খাবার কিনছে। ২২ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বাবদ খরচ কমিয়েছে। আর ১৩ শতাংশ মানুষ সঞ্চয় ভাঙছে। বাকিতে খাদ্য কিনলে তো একসময় দাম পরিশোধ করতে হবে। মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিলে চড়া সুদসহ সেটা পরিশোধ করতে হবে। খাদ্যঝুঁকিতে থাকা ২১ শতাংশ মানুষ যে বাইরে থেকে সহায়তা পাচ্ছে, তা–ও অপ্রতুল।
আসলে বর্তমানে বাজারে দ্রব্যমূল্য অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ার ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন। টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, ডলারের দাম বেড়েছে। আবার ডলার–সংকটও হয়েছে। সব মিলিয়ে মানুষ স্বস্তিতে নেই। কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের স্বার্থ দেখতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, গ্যাস, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজসহ সব ধরনের মসলার দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজেট যেন ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিব না করে। সবার মধ্যে মোটামুটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সরকার বেশ কিছুদিন ধরে বাজার নিয়ন্ত্রণ বিশেষত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেসব তৎপরতা বা অভিযান বাজারকে প্রভাবিত করতে পারছে বলে এখনো অনুভূত হয়নি। বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে মন্ত্রী– প্রতিমন্ত্রীরা সর্বদাই তাদের নিজ নিজ দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। কিন্তু মূল্য পরিস্থিতি ভোক্তার কাঙ্ক্ষিত নাগালের কাছে–মধ্যেই আসছে না! ভরা মৌসুমের মধ্যে একদিকে চালের ঊর্ধ্বমূল্য, অন্যদিকে শাক–সবজির ভালো উৎপাদনের মধ্যে এসবের মূল্য সাধারণের ক্রয়ক্ষমতাকে সদম্ভে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছে! এ অবস্থার মধ্যে অগামীতে সম্ভাব্য সংকটের কথা চিন্তা করে সাধারণের মধ্যে দিশাহারা মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। বলা জরুরি যে, অসাধু ব্যবসায়ীদের কথিত সিন্ডিকেট কর্তৃক দ্রব্যমূল্যের অনিয়ন্ত্রিত চক্রপ্রবাহের মধ্যে পড়ে সাধারণের স্বস্তিও দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে! ভরসা একটাই, এবার অন্তত সরকার বাজার পরিস্থিতি নিয়ে যে উদ্বিগ্ন তা নিজেই স্পষ্ট করেছে।
এ কথা বলা বাহুল্য যে, পণ্যের দাম অনেকটা নির্ভর করে বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর। উৎসব বা বিশেষ বিশেষ সময়ে কিছু কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। আর চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের মূল্যও বাড়তে থাকে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, আমরা যদি সরবরাহ ব্যবস্থাকে ভালো রাখতে পারি, তাহলে সেই চাহিদাটা মূল্যবৃদ্ধির দিকে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখি অনেকে এই সুযোগটা নিয়ে মজুতদারি করেন। এ কারণে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ে। মজুতদারি যাতে না হয় সেদিকে নজরদারি করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় নজরদারি, খবরদারির ক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকে।
বিশ্লেষকরা বলেন, বিভিন্ন খাদ্যপণ্য আমদানির ওপর সরকার কর হ্রাস করলেও ডলারের মূল্যের অজুহাতে সেসব পণ্যের মূল্যহ্রাস তো দূরের কথা স্থিতিশীলই থাকছে না। ফলে সাধারণের মধ্যে কেবল অস্বস্তি নয়, সীমাহীন আতঙ্কও ঘুরপাক খাচ্ছে! এ জন্য নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।