হঠাৎ করেই ধীর হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর গতি। একই সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে দিন। তবে অতীতে বিষয়টি এমন ছিল না, যখন চাঁদ পৃথিবীর কাছাকাছি ছিল। অনেকের কাছেই চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র ধ্রুব সঙ্গী, যা রাতের আকাশে সবসময় দেখা যায়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্ক চিরকাল এমন নাও থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করেছেন, পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহটি আসলে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় দেড় ইঞ্চি করে। এ ক্রমবর্ধমান দূরত্ব এখন কম বলে মনে হলেও এটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে। এমনকি পৃথিবীর গতি আরও ধীর করে তুলবে। এর ফলে পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্যও ক্রমাগত বড় হতে থাকবে। খবর বিডিনিউজের।
পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি সবসময় ওঠানামা করে, যা সাধারণত পরিমাপ করা হয় মিলিসেকেন্ডের হিসাবে। তবে সার্বিকভাবে আমাদের গ্রহের ঘূর্ণন গতি কমে যাচ্ছে বলেই উঠে এসেছে এক প্রতিবেদনে। জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক সাইট টাইম অ্যান্ড ডেটের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পৃথিবীর গতি সাময়িকভাবে বেড়ে যাওয়ার পর ২০২৩ সালে কমতে শুরু করায় দিনের গড় দৈর্ঘ্য প্রথমবারের মতো বেড়ে গিয়েছিল।
ইন্টারন্যাশনাল আর্থ রোটেশন অ্যান্ড রেফারেন্স সিস্টেম সার্ভিসের সর্বশেষ ভবিষ্যদ্বাণী বলছে, এ গতির মন্দা সম্ভবত ২০২৫ সালেও অব্যাহত থাকবে, যেখানে ২০২৪ সালে একটি দিনের দৈর্ঘ্য এর আগের বছরগুলোর দিনের তুলনায় কয়েক মিলিসেকেন্ড দীর্ঘ হতে পারে। অনুমান বলছে, ২০১৯ সালের মার্চের পর থেকে সবচেয়ে বড় দিনের রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে ২০২৫ সালের মার্চ।
পৃথিবীর আহ্নিক গতিতে সার্বিক এ মন্দা চাঁদের মহাকর্ষীয় টানের কারণেও ঘটে। নাসার মতে, চাঁদকে দূরে ঠেলে দেওয়ার এই ক্ষমতা মূলত আসে পৃথিবীর মহাসাগরগুলো থেকে, যা মূলত চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় ফুলে ওঠে। আর একেই আমরা জোয়ার হিসাবে চিনি। পৃথিবীর মহাসাগরগুলো চাঁদের ওপর নিজস্ব একটি মহাকর্ষীয় টান প্রয়োগ করে। এ মিথস্ক্রিয়ার ফলে পৃথিবীর পৃষ্ঠে ঘর্ষণ সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতিও কমে আসে। আর এতে বিভিন্ন এমন শক্তি উৎপন্ন হয়, যা চাঁদের কক্ষপথের ওপরও প্রভাব ফেলে। এর ফলে চাঁদ পৃথিবী থেকে আরও দূরে সরে যায়।
এছাড়া পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে জলবায়ুর পরিবর্তন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, মেরু অঞ্চলে বরফ গলে যাওয়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমে যাওয়ায় কিছুটা অবদান রাখতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিন–ম্যাডিসনের গবেষণা অনুসারে, প্রায় ২০ কোটি বছর পর পৃথিবীতে একেকটা দিন ২৫ ঘণ্টা পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। চাঁদ যেহেতু দূরে সরে যাচ্ছে, সেহেতু পৃথিবী একটি ঘূর্ণায়মান ফিগার স্কেটারের মতো আচরণ করছে, যেখানে স্কেটারের বাহু দুটি ছড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ঘূর্ণন গতিও কমে আসে, বলেছেন ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিন–ম্যাডিসন ভূ–বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও এ গবেষণার সহ–লেখক স্টিফেন মেয়ার্স।
এর আগে চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর সংযোগ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করার লক্ষ্যে পৃথিবীর জলবায়ু চক্রকে ধারণ করে, এমন নয় কোটি বছর পুরনো শিলা গঠনের পলল পরীক্ষা করে দেখেছে গবেষণা দলটি। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ১৪০ কোটি বছর আগে পৃথিবী চাঁদের কাছাকাছি থাকার কারণে এর একেকটি দিনের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১৮ ঘণ্টা। ফলে সে সময় পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর আরও দ্রুত ঘুরত।