অগ্রহায়ণ মাস চলছে, হেমন্তকাল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন রাত বদলে গেছে। কী সুন্দর নির্মল আকাশ। মৃদুমন্দ বায়ু, আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই। আবাহাওয়া না শীত, না গরম। বিশ্বে আমার দেশের মতো জলবায়ু অপূর্ব রূপ কোথাও খুঁজে পাবে না। তাই কবি বলেছেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি। সকল দেশের রাণী সেজে সে যে আমার জন্মভূমি’। কিছুক্ষণের মধ্যে পূর্বাকাশ লাল করে সূর্য ওঠে। এসময় অনেকেই এই রশ্মি শরীরে লাগায় ভিটামিন ‘ডি’ তৈরীর জন্য। ঘাসের দিকে তাকালে স্বচ্ছ শিশির জমেছে ঘাসের ডগায়, ধানের শীষের পরে। গ্রামে দিগন্ত জুড়ে সোনালী ধানের প্রাচুর্য, হলুদে–সবুজে একাকার অপরূপ দৃশ্য। উঠানে কাড়ি কাড়ি ধান মম গন্ধ নবান্নের উৎসব শুরু হয়েছে। কিন্তু আমরা যে কুয়াশা দেখছি সেটা প্রকৃতির কুয়াশা। বাস্তবে আমরা আমাদের সামাজিক জীবন ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন। শীতের এই কুয়াশা আমাদের চোখে দৃশ্যমান জগৎকে আড়াল করে দেয়। কিন্তু বর্তমান সমাজে যে কুয়াশা তৈরী হয়েছে তা আরো গভীর ও ভয়াবহ। এই অমূল্য জীবন কারো কারো কাছে অমূলক। তারা পৃথিবীর মায়া বোঝে না। তারা কী নির্মম, নির্দয়। মনুষ্যত্ব ও মানবাধিকার প্রশ্নে অস্থির পৃথিবী আজ বিভক্ত আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে শাসন আর শোষণে। এর সাথে আছে ভূরাজনৈতিক সংঘাত, সামাজিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা। বর্তমানে সারাদেশে সর্বসাধারণের খারাপ অনুভূতির একটা বিষয় হলো সর্বক্ষেত্রে অস্থিরতা ভীষণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তা না কমে বরং দিন দিন বাড়তেছে। এক পর্যায়ের মানুষ অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। এটা স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য দুর্বিষহ। পরিসংখ্যান দেখা যায় প্রতিদিন সারাদেশে ১৪/১৫ জন খুন হচ্ছে, এটা গণমাধ্যম প্রকাশিত। এছাড়া অস্ত্র নিয়ে একে অপরকে ঘায়েল করা, ছিনতাই, অপহরণ, মব ভায়োলেন্স, দখলবাজি, ক্ষমতার লড়াই, লুট, ডাকাতি লেগেই আছে। নারীঘটিত ব্যাপার অহরহ ঘটছে। একটু কথা কাটি থেকে খুনাখুনি হয়ে যাচ্ছে। এতে বুঝা যায় মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতা। সহিষ্ণুতার অভাব ও ধৈর্যশক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। তার মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিবেদ, পাল্টাপাল্টি বাকবিতণ্ডার লড়াই লেগেই আছে।
এমতাবস্থায় দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা খুবই দরকার। মানুষের মনে গ্রামে গঞ্জে, শহরে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। আসলে জনগণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য উদ্বিগ্ন। খুন হওয়ার কারণ হচ্ছে সন্ত্রাস, সহিংসতা, ব্যবসায়িক ভাগভাটোয়ারা, দখল, বিরোধ, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে মূল্যবোধের অভাব, বাবা অথবা মা নিজের শিশু সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করছে। বাবা ও মা খুন হচ্ছে নিজ সন্তানের হাতে। বন্ধু বন্ধুকে গলাকেটে হত্যা করছে। রাস্তা বা ডোবা থেকে বা মাটির নিচ থেকে উদ্ধার হচ্ছে নর নারীর খণ্ডিত লাশ, দুর্বৃত্তদের হাতে হাতে অস্ত্র, ককটেল, একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা খুললেই প্রথমে চোখে পড়ে খুন খারাবির খবর। প্রশ্ন জাগে কেন এই নির্মমতা? কেন এই পাশবিকতা? কেন এই অস্থিরতা কারণ মূল্যবোধের অবক্ষয়। বিচারহীনতা, প্রযুক্তিগত প্রসার প্রসঙ্গ। এর অপব্যবহার এবং আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো বা আইনকে অবজ্ঞা করা। সচেতন নাগরিকদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। গবেষকরা বলছেন পারিবারিক সহিংসতার পেছনে ব্যক্তিপর্যায়ে অস্থিরতা কাজ করছে। মূল্যবাধের অবক্ষয়ের জন্য বেশি দায়ী ঐতিহ্যগত শিষ্টাচারগুলোকে অবজ্ঞা করা। তারা আরো বলেন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ধারা জটিল ও বহুমাত্রিক। শিক্ষা অর্থনীতি প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে সত্য কিন্তু সেখানে সাংস্কৃতিক রুচির মূল্যবোধের সংকট তৈরী হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও কঠোর ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তেমনি পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানুষের মধ্যে বেপরোয়া ভাব রোধ করতে হবে। ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার কারণ উদঘাটন করতে হবে। অন্যদিকে দেশের সুশীলসমাজসহ সব রাজনৈতিক দলসমূহ দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সমঝোতায় এসে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে এই অস্থিরতা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সরকার গঠন যতই তাড়াতাড়ি হবে ততই মঙ্গল। জনগণ দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাবে শান্তি বিরাজ করবে।
লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।










