চট্টগ্রামে আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী এবং অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র ‘বার্স্টফায়ার’ করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ। গত মঙ্গলবার দুপুরে ওয়ারল্যাস সেটে তিনি সিএমপির সব সদস্য, টহল ও থানা পুলিশকে একযোগে মৌখিক এ নির্দেশনা দেন। সিএমপি কমিশনার বলেছেন, শটগান হবে না, চায়না রাইফেলও বাদ, এখন এসএমজি বার্স্টফায়ার মুডে থাকবে। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী দেখামাত্র বার্স্টফায়ারে হত্যা করতে হবে।
বেতারবার্তার বিষয়ে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, আমি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র বার্স্টফায়ারে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছি। কেন দিয়েছি? আমি আমার এই নগরীর সুনাগরিকদের সব ধরনের অপরাধী, সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে নিরাপত্তা দিতে চাই। এজন্য ১০, ২০ কিংবা ৫০ জন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে হত্যা করলে অসুবিধা হবে না। তিনি বলেন, আমরা নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে চাই। এই নিরাপত্তার জন্য যারা হুমকি তাদের এই নগরী কিংবা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কি খুব বেশি দরকার আছে? তিনি বলেন, অনেকেই এটাকে ব্রাশফায়ার বলে ভুল করছেন। আসলে আমি বার্স্টফায়ারের কথা বলেছি, যেখানে একইসাথে কয়েক রাউন্ড গুলি করা হয়।
এই নির্দেশনা আগেও ছিল বলে উল্লেখ করে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, আগে সিঙ্গেল রাউন্ড গুলি করার অর্ডার ছিল। এখন একই সঙ্গে একাধিক রাউন্ড গুলি করার অর্ডার দিয়েছি। এটা আইন মেনে দেয়া হয়েছে এবং পুলিশের আত্মরক্ষার অধিকার আইনে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমার এলাকায় ঢুকে প্রকাশ্য দিবালোকে একটা খুন করে গেল। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে তারা যেন আর সাহস না পায়। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে চট্টগ্রাম নগরে ঢোকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তারা যেন স্বপ্নেও এটি কল্পনা করতে না পারে যে, এখানে নিরাপদে অপরাধ করে সটকে পড়া যাবে। সেজন্যই এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
আসলে জনসাধারণ আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বিগ্ন। সামপ্রতিক সময়ে দেশে খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সকলকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব খুনের বেশিরভাগই ঘটেছে সামাজিক ও পারিবারিক কারণে। সাধারণত পারিবারিক কলহ, অর্থ লেনদেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হাতে এঁরা খুন হয়েছেন। আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড।
অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪/১৫ জন খুন হচ্ছেন। তবে এসব খুনের বেশিরভাগ ঘটছে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে। বাবা অথবা মা নিজের শিশু সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করছেন। বাবা অথবা মাও খুন হচ্ছেন সন্তানের হাতে। রাস্তা বা ডোবা থেকে উদ্ধার হচ্ছে তরুণীর খণ্ডিত লাশ। এতে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে সচেতন নাগরিক এমনকি জনসাধারণের মাঝে। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে হত্যাকাণ্ড।
কেন এই নির্মমতা? কেন এই পাশবিকতা? কেন এই অস্থিরতা? এর উত্তরে অপরাধ বিশেষজ্ঞ, নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশিষ্টজনরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা ও প্রযুক্তির প্রসারের কারণে ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যেমন আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে, তেমনি পারিবারিক সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক অনুশাসনের প্রতি জোর দেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।
গবেষকরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতার পেছনে ব্যক্তি পর্যায়ে অস্থিরতা অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় যেসব মূল্যবোধ রয়েছে, সেগুলো মেনে চললে ব্যক্তি কিংবা পরিবার–এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সহায়ক হবে। অপরাধ বেড়ে যাওয়া, মূল্যবোধের অবক্ষয়–এসবের জন্য বেশি দায়ী ঐতিহ্যগত শিষ্টাচারগুলোকে অবজ্ঞা করা। মোটকথা, পারিবারিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে দরকার সুস্থ পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক মেলবন্ধন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ধারা একটি জটিল ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া, যার উৎস ও পরিণতি গভীরভাবে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন যেখানে সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে, সেখানে সাংস্কৃতিক রুচি, মূল্যবোধ ও সম্পর্কের জায়গায় সংকটও তৈরি করেছে। মনে রাখা দরকার পরিবর্তন বা বিবর্তনকে মেনে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই, আবার যেকোনো পরিবর্তনই কাম্য নয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন শুধু অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ না রেখে, একটি মানবিক, মূল্যবোধসম্পন্ন ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে–এটাই ভবিষ্যতের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ। সমাজে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ও অসন্তোষের পেছনের কারণগুলো উদ্ঘাটন করে ব্যবস্থা নিতে হবে।






