মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের মুখে রাখাইনের জন্মভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা স্বদেশে ফেরার জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। রোহিঙ্গার ঢল নামার ৭ বছরের মাথায় রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার আকুতি জানিয়ে সমাবেশ করেছেন লাখ লাখ রোহিঙ্গা। প্রত্যাবাসন ও ২৫ আগস্ট স্মরণে উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে এই সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয়। এতে রোহিঙ্গা নেতারা তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, ভিটে মাটি ফেরত ও সম্মানের সাথে মিয়ানমারে ফেরত নিয়ে যাওয়ার দাবি জানান। রোববার ভোর থেকে ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে উখিয়া ১৩ ও ১৮ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের খেলার মাঠে জড়ো হয় রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ। তখন তারা ‘মিয়ানমারে গণহত্যা বন্ধ করো, গণহত্যা বন্ধ করো’ নানান স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প।
সমাবেশে পাঁচ দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সব ধরনের সহিংসতা ও হামলা বন্ধ, আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বসবাসের সুযোগ তৈরি, জান্তা ও আরাকান আর্মিকে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা। এ সময় বাংলাদেশে বন্যা আক্রান্ত ১০ লাখ মানুষের জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন রোহিঙ্গা নেতারা। সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা আবদুর রশিদ বলেন, আমরা এ দেশের অতিথি। তবে দিন অনেক গড়িয়েছে, আর নয়। আমাদের এখনই জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়া উচিত। ঐক্যবদ্ধ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। মিয়ানমারে না গিয়ে অন্য দেশে গেলে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব থাকবে না।
দিনের পর দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে জন্মহার। সরকারি বা এনজিওর জরিপ মতে ১২ লাখ রোহিঙ্গা ধরা হলেও সাত বছরে বেড়েছে আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। এছাড়া রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মাদক পাচার, অপহরণ, মানবপাচারসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রতিনিয়তই খুন, সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটছে। এটা স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, আমরা কবে দেশে ফিরতে পারবো জানা নেই। ২৫ আগস্ট আমরা সাত বছর পূর্তি উপলক্ষে ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে সভা–সমাবেশ করছি। এই সমাবেশের মাধ্যমে আমরা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে চাই, মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যাতে স্বদেশে ফিরতে পারে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর সভাপতি মোহাম্মদ জুবাইর বলেন, ছোট এই বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা দিন দিন বোঝা হয়ে যাচ্ছে। তাই, আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি অনুরোধ, যেকোনো উপায়ে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক এই রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হোক।
সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরত যায়নি। রোহিঙ্গারা মনে করে, তাদের নাগরিকত্ব, জাতিগত পরিচয়, জায়গা–জমি ও গণহত্যার বিচারের নিশ্চয়তা না পেলে তারা মিয়ানমারে গিয়ে আবারও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পড়বে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার সামসুদ্দৌজা বলেন, ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা আগমনের ৭ বছর পেরিয়ে আট বছরে পদার্পণ করেছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের তাদের মতো করে সভা–সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রাখাইনে এখনও যুদ্ধ চলছে। সেখানকার পরিস্থিতি খুব খারাপ। ওখানকার যুদ্ধের গোলাবারুদের শব্দে এপারের মানুষ পর্যন্ত ভয়ে তটস্থ। কবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে সে তথ্য আমার কাছে নেই। অবশ্য, নতুন করে যাতে আর কোনও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সীমান্তে বিজিবি শক্ত অবস্থানে আছে।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ রোহিঙ্গা শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত ৭ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।