ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ও একজন মানবিক মানুষ রেজাউল করিম আজাদ

মনিরুল মনির, সৈয়দ মো. আকবর | শুক্রবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

নানারকম দূষণ আমাদেরকে ব্যাধিগ্রস্ত করে তুলেছে। বেঁচে থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে দিন দিন ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ছে। চট্টগ্রামে ক্যান্সারের চিকিৎসা সেবা কিংবা ব্যবস্থার বিবিধ উপায় অপ্রতুল। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা চেম্বার করলেও চিকিৎসার সুযোগ খুব কম। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ নেই।

আশাভরসার মাঝে সুখবর হলো বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল। এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি ছিল অনেক কঠিন। পাহাড়সম। নগরীর আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসাপাতালের পাশে এই ক্যান্সার ইনস্টিটিউটটি গড়ে উঠেছে। এই হাসপাতাল নির্মাণ ব্যয় শত কোটি টাকারও বেশি। তবে প্রাথমিকভাবে ভবন তৈরিসহ চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করতে তখনই অন্তত ৩৫ কোটি টাকার প্রয়োজন ছিল। এই অনুদান সংগ্রহের জন্য দেশবিদেশের অনেক শুভানুধ্যায়ীর নিকট আবেদন করা হয়েছিল। কাজটি শেষ করতে বেশ কিছু সহযোগিতা পাওয়া গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে, বিগত সরকারের সময় বিশেষায়িত এই হাসপাতালের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আট কাঠা মূল্যবান ভূমি বরাদ্দ ছিল।

পারমাণবিক শক্তি কমিশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমোদিত এই হাসপাতালটি ক্যান্সার গবেষণার দুয়ারও উন্মেচিত করেছে। মা ও শিশু হাসপাতালের ১০ হাজারেরও বেশি আজীবন সদস্য এই কাজে সবসময় সহযোগিতা করে গেছেন।

চট্টগ্রামের মানুষের ক্যান্সার চিকিৎসায় ভরসা ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের মাত্র ৪৮টি শয্যা। নতুন এই হাসপাতাল এই অঞ্চলের গরিব ও অসহায় রোগীদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনবে।

এই ক্যান্সার ইনস্টিটিউট প্রকল্প বাস্তবায়নে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেককে চেয়ারম্যান, বিজিএমইএর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম আবু তৈয়বকে কোচেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ গভর্নিং বডির ভাইস চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আজাদকে সদস্য সচিব ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোরশেদ হোসেনসহ অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব এই কমিটির সদস্য ছিলেন। চূড়ান্তভাবে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। দৈনিক আজাদী এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মিডিয়া পার্টনারের দায়িত্ব পালন করেছে।

এই উদ্যোগের পেছনে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ গভর্নিং বডির ভাইস চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আজাদ। তিনি জানান, অবকাঠামোগত কাজ শেষ। ইতোমধ্যে অনেকগুলো ইউনিট চালু হয়ে গেছে।

রেজাউল করিম আজাদ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ সালে রাউজানের নদিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইউনুচ মিয়া একজন সমাজসেবক ছিলেন, তিনি ইউনুচআলমাচ স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ছৈয়দিয়া ইউনুচিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পিতার মতো রেজাউল করিম আজাদ সমাজসেবা ও মানুষের সেবা করার ব্রতকে আদর্শ করে নিয়েছেন। চট্টগ্রামের বৃহৎ চিকিৎসা কেন্দ্রের নানামুখী কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি জড়িত রয়েছেন।

আমরা জানি বৈশ্বিক মহামারীতে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত। ওই সময় এগিয়ে এসেছেন ফ্রন্টলাইনে রেজাউল করিম আজাদ। মা ও শিশু হাসপাতালে খুলেছেন করোনা বিভাগ।

১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষ উপলক্ষে চট্টগ্রামের কিছু মহৎ প্রাণ সমাজ হিতৈষী ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র শিশু স্বাস্থ্য বহির্বিভাগের মাধ্যমে এই হাসপাতালের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এটি একটি বিশাল চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ লাভ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে বর্তমানে একটি ৬৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট, একটি নার্সিং কলেজ, একটি অর্টিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট নির্মাণসহ এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। এই উজ্জ্বল স্বপ্ন চট্টগ্রামেরবাসীর জন্য কল্যাণের ও আশার।

২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এপ্রিল মাস থেকে দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঠিক তখন থেকে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসে। হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির ৪৫৩তম সভায় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য এক ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন হাসাপাতাল ভবনের ২য় ও ৩য় করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৩য় তলায় সেন্ট্রাল অঙিজেন লাইন স্থাপন করা হয় এবং ১ম পর্যায়ে ৩৪টি শয্যা করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য প্রস্তুত করা হয়। ২০২০ সালে ৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন হাসপাতাল ভবনে করোনা ইউনিট চালু ও করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা শুরু করা হয়। পরবর্তীতে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। ৯২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয় আরটিপিসিআর ল্যাব। করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালের উদ্যোগটি সবার কাছে ছিল মাইলফলক। করোনা ইউনিটের জন্য আলাদাভাবে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ দেয়া হয়। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। যা সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সর্বমহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নতুন ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় পূর্ণাঙ্গ কার্ডিয়াক ইউনিট ও অত্যাধুনিক ক্যাথ ল্যাব স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চালু হলে চট্টগ্রামে হার্টের রোগীরা কম খরচে এনজিও গ্রাম, এনজিও প্লাস্টিসহ সকল চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছেন।

এই প্রকল্পে সৈয়দ আজিজ নাজিম উদ্দিনকে কোচেয়ারম্যান, ট্রেজারার মো. রেজাউল করিম আজাদকে মেম্বার সেক্রেটারি ও হাসপাতালের শিশু আইসিইউ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফাহিম হাসান রেজাকে সমন্বয়কারী করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছিল।

২০২১২০২৪ মেয়াদে হাসপাতালের বিশেষ বিশেষ কার্যক্রম চালু রয়েছে। তা হলো, ১০০০ শয্যা বিশিষ্ট নতুন হাসপাতাল ভবনের কাজ সম্পন্ন ও পুরোদমে চালু। ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টারের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন ও পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল চালু। ৩৪ শয্যা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক সিসিইউ ও ক্যাথল্যাব স্থাপন। ৩০ শয্যা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক নতুন আইসিইউ ও এইচডিইউ স্থাপন। দুটি মডিউলার অপারেশন থিয়েটারসহ মোট ৯টি অপারেশন থিয়েটার কমপ্লেক্স চালু। ৪৫ শয্যা বিশিষ্ট এনআইসিইউ সহ মোট ৮০ শয্যায় নিওনেটাল ওয়ার্ড সমপ্রসারণ। ৫০ শয্যায় পেডিয়াট্রিক আইসিইউ ওয়ার্ড সমপ্রসারণ। নতুন হাসপাতাল ভবনের ৬ষ্ঠ তলার ছাদে নতুন অঙিজেন জেনারেশন প্ল্যান্ট স্থাপন। হেমোডায়ালাইসিস ইউনিট সমপ্রসারণ। রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং ও ল্যাবরোটরি মেডিসিন বিভাগ (ডায়গনস্টিক বিভাগ) নতুন আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে। অবস এন্ড গাইনী বিভাগ ২০০ শয্যায় উন্নিত করা হয়েছে এবং নতুন আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে। ২০ শয্যা বিশিষ্ট নিউরোসার্জারী ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। জরুরি বিভাগে আগত রোগীদের আরো উন্নত চিকিৎসা প্রদানের লক্ষ্যে ২০ শয্যা বিশিষ্ট এএমইউ ও ইমার্জেন্সি বিভাগ চাল করা হয়েছে। হাসপাতালের বহির্বিভাগের মুমূর্ষু শিশুদের দ্রুত চিকিৎসা প্রদানের লক্ষ্যে শিশু এএমইউ ও ইমার্জেন্সি ইউনিট চালু করা হয়েছে। হাসপাতাল পরিমণ্ডলের ভেতর দৃষ্টি নন্দন সেন্ট্রাল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।

মানবিক একপ্রাণ রেজাউল করিম আজাদ এই হাসপাতালকে একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালে পরিণত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হাসপাতালসহ সকল উদ্যোগে তিনি একজন মানবতার প্রতিনিধি হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। গরীব রোগীদের জন্য এই হাসপাতালের দুয়ার সবসময় খোলা রয়েছে। কখনও কোনো রোগী অর্থের অভাবে চিকিৎসা সেবা নিতে অপারগ হলে, তিনি এগিয়ে এসেছেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। এই প্রশংসায় আগামীদিনে চট্টগ্রামবাসীর সেবার জন্য মা ও শিশু হাসপাতাল অনন্য হয়ে থাকবে।

লেখক: মনিরুল মনির : কবি ও প্রকাশক, খড়িমাটি;

সৈয়দ মো. আকবর : আজীবন সদস্য, মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধরহমানের বান্দাদের যে গুণাবলি থাকা অত্যাবশ্যক