ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ বাড়ছে চট্টগ্রামে

বিশ্ব ক্যান্সার দিবস আজ

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

ক্যান্সার। যতটা না মারাত্মক, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কের। কয়েক বছর আগেও মানুষ মনে করত ক্যান্সার মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। অবশ্য এখন সে ধারণা বদলে গেছে। ক্যান্সারের চিকিৎসা এগিয়েছে অনেক দূর। সম্ভব হচ্ছে এর প্রতিরোধ। আছে প্রতিকারও। ক্যান্সারের আভিধানিক অর্থ কর্কট। সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ক্যান্সারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। শরীরের যেকোনো অংশেই হতে পারে ক্যান্সার। প্রতিবছর বিশ্বে ১২ কোটিরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সার রোধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিতে পারলে ২০২৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে মারা যাবে প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষ। বেশ কয়েক বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই তথ্য দিয়েছে। আর ক্যান্সারের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন অব ইন্টারন্যাশনাল ক্যান্সার কন্ট্রোল (ইউআইসিসি)ও ডব্লিউএইচও’র উদ্যোগে ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর ৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব ক্যান্সার দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘সকল ক্যান্সার রোগীর জন্য মানসম্মত চিকিৎসা হোক সহজলভ্য।’
দেশের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ক্যান্সারে ভুগছে এমন রোগীর সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বলা হয়, বর্তমানে দেশে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা ১২ থেকে ১৪ লাখ। প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখের মতো মানুষ। আর আক্রান্তদের মাঝে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ১ লাখ।
অন্যদিকে, এই মরণঘাতী রোগ নিয়ে চট্টগ্রামের চিত্র সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের ধারণা- বৃহত্তর চট্টগ্রামে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ। আর বছরে এ অঞ্চলে নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ। তবে উদ্বেগের বিষয় যে- ক্যান্সার আক্রান্তদের প্রায় ৫০ ভাগ রোগীই কোনো ধরণের চিকিৎসা সেবা পায় না। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরীর মতে, ব্যয়বহুল হওয়ায় চিকিৎসা সেবার আওতার বাইরেই রয়ে যায় অধিকাংশ রোগী। আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগী সরকারি চিকিৎসা সেবা নিতে হাসপাতালে আসে। আর চিকিৎসার জন্য বিদেশকে বেছে নেন সামর্থ্যবান রোগীরা। যাদের সংখ্যা মোট আক্রান্তের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আর বাদ বাকি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রোগী এখনো কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। তারা ঝাড়-ফোঁক, তাবিজ ও কবিরাজি চিকিৎসাতেই ভরসা খুঁজে। অসচেতনতাই এর মূল কারণ।
বাংলাদেশের নারীদের সাধারণত জরায়ু ও স্তন ক্যান্সার এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে মুখ গহ্বর, ফুসফুস, মূত্রনালী ও পাকস্থলীতে ক্যান্সার বেশি হয়ে থাকে। বেশিরভাগ রোগীই শেষ মুহূর্তে চিকিৎসকের কাছে আসেন জানিয়ে এই চিকিৎসকদ্বয় বলেন, ‘রোগীরা এমন পর্যায়ে আমাদের কাছে আসেন যখন তাদের তুলে আনা যায় না। কারণ এদেশে যথাযথ স্ক্রিনিং পদ্ধতি নেই, স্বাস্থ্যনীতিতেও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মধ্যে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা পড়ে না’। তবে মরণঘাতী এই রোগ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত হয়নি। অপ্রতুল চিকিৎসা সেবাও। সংশ্ল্লিষ্টদের তথ্য মতে, দেশের ১২/১৩ লাখ ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় আনুমানিক প্রায় ২০০ জন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও ২০ জনের মতো শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত আছেন। আর দেশে মোট ২২টির মতো হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার কম-বেশী সুবিধা রয়েছে। তবে এসবের অধিকাংশতেই রয়েছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম স্বল্পতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যান্সার আক্রান্তদের প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীকে রেডিওথেরাপি নিতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) মানুষের জন্য অন্তত একটি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা বাঞ্চনীয়। যাতে রেডিওথেরাপি মেশিন অবশ্যই থাকবে। সে হিসেবে ১৫/১৬ কোটি মানুষের জন্য বাংলাদেশে ন্যূনতম ১৫০ থেকে ১৬০ টি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকার কথা। কিন্তু সারা দেশে রেডিওথেরাপি মেশিন সমৃদ্ধ চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ১৩টি। আর দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৫ কোটি মানুষের জন্য মেশিনসহ চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে মাত্র এই (চমেক হাসপাতাল) একটি।
তাতেও ক্যান্সারের চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রকট অভাব দীর্ঘদিন ধরে। তবে বর্তমানে এ সংকট অনেকটাই দূর হয়েছে। দিন দিন ক্যান্সার চিকিৎসায়ও সুযোগ বাড়ছে চট্টগ্রামে। হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগে বর্তমানে রেডিওথেরাপি ও ব্র্যাকিথেরাপি সেবা চালু রয়েছে। সমপ্রতি যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক সিটি স্টিমুলেটর মেশিনও। আগে রেডিওথেরাপি মেশিন অকেজো হলেই দীর্ঘ দিন সেবা বন্ধ থাকতো। এতে করে রেওিথেরাপি সেবা নিতে ঢাকায় ছুটতে হতো রোগীদের। তবে বেশ ক’বছর ধরে অনেকটা ধারাবাহিকভাবে এ সেবা পাচ্ছে চট্টগ্রামের রোগীরা।
এদিকে, চমেক হাসপাতালে নতুন একটি ক্যান্সার ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। গত ৯ জানুয়ারি ভার্চুয়ালি এ ভবনের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৫ তলা বিশিষ্ট এ ভবনে ৭ম তলা পর্যন্ত থাকছে ১৮০ শয্যার বিশেষায়িত ক্যান্সার ইউনিট। এটি চালু হলে চট্টগ্রামের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে মনে করেন চমেক হাসপাতাল ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ। বিশেষায়িত এই ইউনিটে ক্যান্সারের চিকিৎসায় অত্যাধুনিক সব চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকবে জানিয়ে ডা. সাজ্জাদ বলেন, ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় যা প্রয়োজন, এক কথায় সব কিছুই ওখানে থাকবে। দক্ষ চিকিৎসক-নার্সের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জনবলও নিশ্চিত করা হবে। মোটকথা, বিশেষায়িত ক্যান্সার ইউনিটটি চালু হলে চট্টগ্রামে ক্যান্সারের চিকিৎসায় আমূল পরিবর্তন আসবে। কোনো রোগীকে আর রাজধানী ঢাকায় ছুটতে হবে না। সরকারের বিশেষায়িত এই ক্যান্সার ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ চট্টগ্রামবাসীর জন্য বড় ধরণের আর্শিবাদ বলে মনে করছেন ডা. আলী আসগর চৌধুরী। মোটকথা, নির্মাণাধীন বিশেষায়িত এ ক্যান্সার ইউনিটটি চট্টগ্রামের জন্য আশার আলো হয়ে দেখা দেবে বলেও মন্তব্য এ চিকিৎসকের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএই স্বীকৃতি আরো উৎসাহ যোগাবে : ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ
পরবর্তী নিবন্ধএগোতে থাকে বাঙালির ভাষা আন্দোলন