আজ আন্তর্জাতিক ক্যান্সার দিবস। ক্যান্সারের সচেতনতা বৃদ্ধি, শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসায় উৎসাহিত করার জন্য প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির চার তারিখ এ দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বাংলাদেশ ক্যান্সার ফাউন্ডেশন, সোসাইটিসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে।
ক্যান্সার একটি অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধিজনিত রোগ, যা শরীরের অন্যান্য অংশের উপর আক্রমণ বা বিস্তার লাভ করে। সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ ক্যান্সার। ক্যান্সার তুলনামূলক একটি ভীতিকর রোগ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে শরীরের যেকোনো অঙ্গেই এ রোগ হতে দেখা যায়। তবে সঠিক সময়ে এ রোগ শনাক্তকরণ ও যথাযথ চিকিৎসা, মানুষকে অনেক অংশে সুস্থ করে তোলে। ধূমপান, অ্যালকোহল, জর্দা-তামাকপাতা, কিছু প্রক্রিয়াজাত খাবার, রেডমিট, পোড়া খাবার খাওয়া; এছাড়া আঁশযুক্ত খাবার, সবজি, ফলমূল, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম কম খাওয়া, শারীরিক ব্যায়াম না করা, শারীরিক স্থূলতা বা বেশি ওজন, আলট্রাভায়োলেট রশ্মি, এঙ-রেডিয়েশন, কিছু রাসায়নিক পদার্থ, কিছু ভাইরাস ও অন্যান্য কারণে ক্যান্সার হয়ে থাকে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ক্যান্সারের কারণে সারা বিশ্বে প্রায় ৮ কোটি মানুষ মারা যায়। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যে কারো, যে কোনো বয়সে, যে কোনো সময়ে রোগটি হতে পারে। তবে কিছুটা সচেতনতা আর নিয়মানুবর্তিতা আমাদের এ রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। যেসব ধরনের খাবার খেলে এ রোগ হয়, আমাদের সেসব খাবার থেকে পুরোপুরি দূরে থাকা উচিত। সঙ্গে যেসব খাবার আমাদের নিয়মিত খাওয়া উচিত, সেসব খাবার নিয়ম করে খাওয়া দরকার। আর এ দু’টি কাজ করলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে দূরে থাকা সম্ভব। ক্যান্সার অনেক ধরনের। হয়তো আমাদের সব ধরনের ক্যান্সার সম্পর্কে ধারণা নেই। আমাদের আশেপাশে কারো মধ্যে যেকোনো রকমের ক্যান্সারের লক্ষণ থাকলে আমরা সহজে বুঝতে পারবো না। রোগটি সামান্য পর্যায় থেকে গুরুতর পর্যায়ে চলে যাবে। তাই সবার উচিত ক্যান্সারের লক্ষণ সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান রাখা।
গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরির (জিসিও) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সারা বিশ্বে নতুন করে ১ কোটি ৮০ লাখ ১০ হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে এবং ৯৬ লাখ মানুষ ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে। ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর অর্ধেকের বেশি হয়েছে এশিয়ায়। যেখানে আছে বিশ্ব জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ মানুষ। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলে খাদ্যনালী, পাকস্থলী ও লিভার ক্যান্সারের হার অনেক বেশি। গ্লোবোকেনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে নতুন করে দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে, ১ লাখ ৮ হাজার মানুষ ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে। খাদ্যনালী, মুখগহ্বর, স্তন, ফুসফুস ও জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তের হার সর্বাধিক। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে ২ কোটি ৯৫ লাখ নতুন ক্যান্সার রোগীর সৃষ্টি হবে, যার ৩০-৫০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য।
ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয় বিশাল। তার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত নীতিমালা, দক্ষ জনবল, ওষুধের সহজলভ্যতা, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং উদার বিনিয়োগ। ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব মেডিকেল অনকোলজি ২০১৭ সালে এক রিপোর্টে উল্লেখ করে, ক্যান্সারের ওষুধ সহজলভ্য না হলে তা কম কার্যকরী অথচ বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসম্পন্ন চিকিৎসার দিকে রোগীকে ধাবিত করবে। এ জন্য ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও ওষুধের সহজলভ্যতা জরুরি।
ক্লিনিক্যাল অনকোলজিস্ট ডা. আলী আসগর চৌধুরী তাঁর এক লেখায় ক্যানসারের ওষুধ সহজলভ্য করার জন্য কিছু প্রস্তাবনা প্রদান করেছিলেন। যেমন : ক. ক্যান্সারের ওষুধের রেজিস্ট্রেশন ও অনুমোদন সময় কমিয়ে আনা যেতে পারে। খ. উচ্চমূল্যের ওষুধগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আর্থিক অনুদান দেওয়া যেতে পারে। গ. নির্দিষ্ট কিছু ওষুধকে স্বল্পমূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ঘ. সরকার ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। ঙ. মানসম্মত জেনেরিক ও বায়োসিমিলার ওষুধগুলোর সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে। চ. ওষুধ কোম্পানিগুলো রোগী সহায়তামূলক কর্মসূচি নিতে পারে। ছ. এনজিও বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্যানসার রোগীদের সহায়তার কর্মসূচি নিতে পারে। জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন প্রণয়ন, ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, দক্ষ জনবল সৃষ্টি, মৌলিক গবেষণা পরিচালনা এবং যথাযথ চিকিৎসাপদ্ধতি বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন-এই নীতিমালার আলোকে আমাদের দেশের ক্যান্সার চিকিৎসা এগিয়ে নিতে হবে।