এক সময় বলা হতো–ক্যান্সার হলে আনসার (উত্তর) নাই। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিকায়নের সাথে সাথে ক্যান্সার চিকিৎসারও অনেক অগ্রগতি হয়েছে। ক্যান্সারের আনসার মিলছে এখন। ক্যান্সারকে জয় করে দিব্যি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন অনেকেই। চট্টগ্রামে ক্যান্সার চিকিৎসায় এক সময় শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালই ছিল ভরসা। তবে ক্যান্সার চিকিৎসায় বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠা চট্টগ্রামের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার। বর্তমানে এখানে বিশেষায়িত সেবার মধ্যে রয়েছে– রেডিয়েশন অনকোলজি, মেডিক্যাল অনকোলজি, সার্জিক্যাল অনকোলজি, গাইনি অনকোলজি, অনকো ক্রিটিক্যাল কেয়ার, পেলিয়েটিভ কেয়ার, হেমাটোলজি কেয়ার, শিশু অনকোলজি ও হেমাটোলজি। এসব সেবা নিতে এখন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে ছুটে আসছেন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা। কারণ হাসপাতালের চৌকস বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলের সেবা পেয়ে অনেক রোগী ক্যান্সারকে জয় করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।
জানা গেছে, সাধারণ মানুষের ক্যান্সার চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্য সামনে রেখে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বমানের একটি ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য সাংবাদিক ও দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেককে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয় ১০১ সদস্যের ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি। দেশ–বিদেশের মানুষের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে হাসপাতালের পাশে সরকার থেকে প্রাপ্ত ১০ কাঠা জমিতে ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় ১৫০ শয্যার চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল (চমাশিহা) ক্যান্সার ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের দান অনুদানে এই হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক নিজের মায়ের নামে গড়ে তোলা মালেকা খাতুন অনকোলজি ওয়ার্ডের জন্য এক কোটি টাকা অনুদান দেন। ইতোমধ্যে সেই অনুদানের টাকায় নির্মিত ওয়ার্ডে ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন দূরদুরান্তের রোগীরা। আজ সকাল ১০ টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ওয়ার্ডের উদ্বোধন করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
এদিকে গতকাল বিকেলে মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টারের ‘মালেকা খাতুন অনকোলজি ওয়ার্ড’ ঘুরে দেখা গেছে, চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীদের সেবায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। ওয়ার্ডে সংক্রমণ ঠেকাতে দায়িত্বরত নিরাপত্তারক্ষী একজন রোগীর বিপরীতে একজনের বেশি লোককে প্রবেশ অনুমতি দিচ্ছেন না।
মালেকা খাতুন অনকোলজি ওয়ার্ডে এক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের গারাঙ্গিয়া গ্রামের বাসিন্দা ওমান প্রবাসী মোহাম্মদ জাকারিয়া। ওমান থেকে বেড়াতে এসে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৮ মাস আগে ধরা পড়ে রেক্টাম ক্যান্সার। শুরু থেকে তিনি মা ও শিশু ক্যান্সার হাসপাতালের চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে একটা কেমোথেরাপি নিয়েছেন তিনি। চিকিৎসার সামগ্রিক সেবায় তারা সন্তুষ্ট বলে জানান রোগীর ভগ্নিপতি শহীদুল হক। পাশের বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন হাটহাজারী পৌরসভার দেওয়ান নগর এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আবদুস সোবহান। পঞ্চাশোর্ধ্ব সোবহানের ৫ মাস আগে প্রস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। আত্মীয়–স্বজনের পরামর্শে তিনি এসেছেন মা ও শিশু ক্যান্সার হাসপাতালে। রোগীর ছেলে সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা আবু পারভেজ বলেন, আমার বাবার প্রস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়েছে। এর আগে একজন বিশেষজ্ঞ ইউরোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে ওনার সার্জারি হয়। সে সময় ওনার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আল্লাহর রহমতে, ওনি এখন বেশ ভালো আছেন। মা ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকদের আন্তরিকতা আসলে অতুলনীয়।
অপরদিকে সন্দ্বীপ থেকে জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে এসেছেন গৃহিনী নারগিস খান। তিনি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পরে শেষ ভরসা হিসেবে এসেছেন মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টারে। রোগীর ছেলে মোহাম্মদ স্টার বলেন, আমার মায়ের সার্বিক অবস্থা ভালো নয়। ওনি স্টেজ ফোরে আছেন। আসলে আমরা অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি।
মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. শেফাতুজ্জাহান বলেন, মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, ক্যান্সার রোগীদের সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা প্রদান করা। আমরা ক্যান্সার রোগীর আন্তর্জাতিক গাইডলাইন মেনে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। যা ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল রোগীদের জন্য আমাদের যাকাত ফান্ড ও দরিদ্র কল্যাণ তহবিল থেকে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে, যেন কোনো রোগী অর্থের অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন। এই জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের ক্যান্সার হাসপাতালের বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন ১৫ হাজার ২১৭ রোগী। ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ হাজার ৪৭৮ জন। কেমোথেরাপি ও অন্যান্য সেবা নিয়েছেন ৫ হাজার ৯৩৭ রোগী। রেডিওথেরাপি সেবা নিয়েছেন ৭০৭ রোগী এবং সিটি স্টিমুলেশন করা হয়েছেন ৭৬৩ রোগীর। কাজেই রোগীদের সেবার দিক থেকে আমাদের ক্যান্সার হাসপাতাল পুরো চট্টগ্রাম বিভাগে অপ্রতিদ্বন্দী।
মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব রেজাউল করিম আজাদ বলেন, ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামের কিছু মহানুভব ব্যক্তির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতাল আজ দেশের অন্যতম শীর্ষ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়ে ৮৫০ শয্যাবিশিষ্ট চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল, ১৫০ আসনের মেডিকেল কলেজ এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট, ১৫০ শয্যার চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল (চমাশিহা) ক্যান্সার ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই হাসপাতালটি সেবার দিক থেকে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশের সর্বাধুনিক লিনিয়ার এঙিলেরাটর মেশিনসহ ক্যান্সার চিকিৎসার আধুনিক সব যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে এই হাসপাতালে। শুধুমাত্র ক্যান্সার রোগীদের জন্য বাংলাদেশের প্রথম অনকো–ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের আইসিইউ সেবা চালু করা হয়েছে। এখানে ১৬টি আইসিইউ শয্যা রাখা হয়েছে। আরেকটি বিষয়–এই ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ার পিছনে মূল ভূমিকা পালন করেছেন এই চট্টগ্রামের অভিভাবকতুল্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। তিনি পাশে না থাকলে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ আমরা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারতাম না। শুধু তাই নয়, করোনা মহামারীর সময় তিনি হাসপাতালে লায়ন্স সাপোর্ট সেন্টার তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। এই সাপোর্ট সেন্টারের মাধ্যমে অসংখ্য করোনা রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।