ক্যান্সার মানব শরীরের রোগ। এর ব্যাপকতা বেশি। কয়েক দশক আগেও এটি শনাক্ত করতে পারতো না বলে মানুষ হতাশায় ভুগতো। কথায় কথায় বলতো ‘আমার ক্যান্সার হয়েছে আমি আর বাঁচবো না’। ইদানীং মেডিক্যাল সাইন্সের অভাবনীয় উন্নতির ফলে এই মরণব্যাধি ক্যান্সারকে মানুষ জয় করতে শুরু করেছে। মানুষ আরোগ্য লাভ করছে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। ক্যান্সার নিয়ে ভাবনা আর না আর না। বয়স্কদের মধ্যে প্রতি ১০ জনে একজন ক্যান্সার রোগী। আধুনিক যন্ত্রপাতির বদৌলতে ও নূতন নূতন চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবনের ফলে অনেকাংশে ক্যান্সার রোগকে জয় করতে সমর্থ হয়েছে। এই রোগের প্রথম শর্ত হলো অতি দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা আরম্ভ করা। সুতরাং সাবধানতার মাইর নাই। শরীরের যে কোনো জায়গায় কিছু অস্বাভাবিক দেখা দিলে কালক্ষেপণ না করে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের নিকট যাওয়া। ডাক্তারের পরামর্শ মতো পরীক্ষাগুলো করুন এবং শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা শুরু করুন। আমাদের দেশেও বিভিন্ন জায়গায় ক্যান্সার হাসপাতাল চালু হয়েছে। সুযোগ সুবিধা বিগত দিনের তুলনায় বাড়ছে। অবস্থা বুঝে ক্যান্সারের প্রথম ধাপের চিকিৎসা সার্জারি (অপারেশন), কারণ আক্রান্ত টিস্যু শরীর থেকে বাদ দিতে হবে ও রোগ নির্ণয়ের জন্য সেই টিস্যু পরীক্ষা করতে হবে। তবেই চিকিৎসা পুরোদমে শুরু হবে। চট্টগ্রাম মা ও শিশু ক্যান্সার হাসপাতালে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। ঢাকায় প্রচুর ক্যান্সার হাসপাতাল আছে। এটা ভালো লক্ষণ। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারগণ ও টেকনিশিয়ানগণ উচ্চতর ট্রেনিং নিচ্ছেন। এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। বিভিন্ন দেশে ক্যান্সারের আক্রান্ত টিস্যু সমূলে উৎপাটনের জন্য রোবোটিক সার্জারি হচ্ছে (মানুষের বিকল্প এটাও মানুষ চালায়) তাতে সফলতার হার বেশি। তবে খুব ব্যয় সাপেক্ষ। দেখা যাচ্ছে এই রোবোটিক সার্জারির ফলে প্রোস্টটিক ক্যান্সার রোগী বেশি দিন ভালো থাকছে। খুব শীঘ্রই আমাদের দেশেও চালু হবে। অপারেশনের পরে অবস্থা দৃষ্টে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কেমোথেরাপি (ইনজেকশন), রেডিওথেরাপি (সেক), মুখে ক্যান্সারের ওষুধ দেওয়া প্রভৃতি চালু হয়েছে। ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী তাই ধৈর্য ধরে চিকিৎসা নিতে হবে, নয়তো রোগ সম্পূর্ণ ভালো হবে না। দীর্ঘদিন গবেষণার মাধ্যমে উন্নত দেশগুলি বেশ কিছু ক্যান্সার রোগের কারণ জানতে পেরেছে এবং গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সাধারণভাবে চিন্তা করতে গেলে জীবন ধারণের পরিবর্তনের ফলেও এই রোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখা যায় – যেমন ধূমপান পরিহার, জর্দা, তামাক জাতীয় খাবার বর্জন, অতিরিক্ত এ্যালকোহল সেবন না করা, অতিরিক্ত লাল মাংস ভক্ষণ না করা, অপরিচ্ছন্নতা, দূষিত পরিবেশ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা, সামাজিক কুসংস্কার বর্জন করা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বিশ্বে হৃদরোগে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি–বছরে প্রায় পৌঁনে দুই কোটি। ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে ৮০ লাখের ওপর। বর্তমান ক্যান্সারের চিকিৎসা বহুভাগে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে করা হয়। শরীরের মাথা হতে পা পর্যন্ত ভেতরে ও বাহিরে সব জায়গায় ক্যান্সার হতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে ৮০% রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ৫০ ঊর্ধ্বে লোকদের প্রোস্টেট ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ছে। তবে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় বিশেষ করে বয়স্ক ক্যান্সার রোগীরা ডাক্তারের নিকট আসে অনেক দেরিতে। যখন স্টেজ পার হয়ে যায় মাঝে মাঝে বয়স্ক মহিলারা স্তন ক্যান্সার নিয়ে আসে। স্তনে ঘা হয়েছে/ ফারগেইটেড হয়েছে গন্ধ বের হচ্ছে। বগলে হাড়ে ছড়িয়ে গেছে। বয়স্ক মহিলা যাদের ক্যান্সার সারভিকস জরায়ুর মুখের ক্যান্সার দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এ পাশ ও পাশ ছড়িয়ে গেছে। অথচ এই জরায়ুর মুখের ক্যান্সার টিকা পাওয়া যায়। শুধু সচেতনতার অভাব। জরায়ুর মুখে যদি সাদা সাদা রস বাহির হয় ও স্পর্শ করলে রক্ত পড়ে প্রথমত বুঝতে হবে ক্যান্সার হয়েছে। এই রকম ভুরি ভুরি রোগী বেশি পাওয়া যায়। আমাদের দেশে জরায়ুর মুখের ক্যান্সারে মৃত্যু শীর্ষে। ইদানীং জন্ডিস হেপাটাইটিস–বি ভাইরাসে আক্রান্ত ৭৩% রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সার শরীরের যে কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গে হতে পারে যে কোনো বয়সে এমনকি শিশুদেরও। ক্যান্সার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এমনও রোগী আছে। আব্বাস উদ্দীনের বয়স ৬৫ বছর। তার প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়েছে। সে মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক। গ্রামে চাষবাস করে খায়। উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে সে চট্টগ্রাম শহরে এসে একজন ইউরোলজিস্ট ডাক্তারকে দেখাল। ডাক্তার ইতিহাস নিয়ে সন্দেহ হওয়াতে যা যা পরীক্ষা দরকার সব করাল। পরীক্ষায় তার প্রোস্টেটগ্রন্থিতে ক্যান্সার ধরা পড়ল। পা না কেটে মেশিনের সাহায্যে তার অপারেশন হলো। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তার অন্যান্য চিকিৎসা শুরু হলো এবং সুস্থ হলো ২০–২২ বছর পর। তার কোনো অভিযোগ নাই।
২০–২২ বছরের শিউলি দাশ সে আগে থেকেই জানতো প্রতিমাসে তাকে হাত দিয়ে তার দুই স্তন ও বোটা পরীক্ষা করতে হবে। দেখল একটা স্তনে পিং পিং বলের মতো গোটা ধরা পড়ছে। সে প্রথমে নার্ভাস বোধ করল। দেরি না করে একজন সার্জনের নিকট গেল। সার্জন দেখে পরীক্ষা করতে বললো। পরীক্ষায় খারাপ কিছু আসে নাই। তবুও গোটাটা অপারেশন করে কেটে ফেলল। শিউলির দুশ্চিন্তা চলে গেল। মনে রাখবেন প্রত্যেক গোটা সেটা যেখানেই হোক ক্যান্সার নয়। সেটা ভালো গোটা, ক্ষতি করবে না। এই রকম কিছু হলে গোটা পরিবার অশান্ত থাকে। বোম্বের এক অভিনেত্রী নাম সোনালী মেটাস্টেটিক ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ২০১৮ সালে। তার সাহস, ইচ্ছাশক্তি এবং বিশ্বাস এই ঘাতক ক্যান্সারকে জয় করে পুনরায় অভিনয়ে ফিরে গেছেন এবং রোমান্স সৃষ্টি করেন। সুতরাং ক্যান্সারকে ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। চট্টগ্রাম শহরের কোন এক ডাক্তার টেস্টিকুলার ক্যান্সার আক্রান্ত হন (অণ্ডকোষ)। তিনি অতি দ্রুত এবং সাহসের সহিত চিকিৎসা চালিয়েছিলেন এবং অদ্যাবধি সুস্থ জীবন যাপন করছেন। সবিতা রাণী খাদ্যনালির ক্যান্সারে খেতে পারতো না, আটকে যেতো, সার্জারি ও অন্যান্য চিকিৎসা করে বহুদিন ভালো আছেন। একটা সুখবর হলো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ভালো ভালো ইনকেজশন ও মুখে খাওয়ার ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে। আমাদের দেশেও পাওয়া যাচ্ছে। পরিশেষে ক্যান্সারকে ভয় না করে জয় করুন, দীর্ঘায়ু লাভ করুন।
লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।