কোরবানির ঈদের সময় পশু কোরবানির জন্য পেশাদার কসাইয়ের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন জেলা ও গ্রামে যেখানে আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় বা পরিচিত কসাইয়ের মাধ্যমে কোরবানি সম্পন্ন হয়, সেখানে চট্টগ্রামের মতো মেট্রোপলিটন এলাকায় চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখানে পেশাদার ও প্রশিক্ষিত কসাইয়ের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় কম।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে মোট মাংস ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ হলেও প্রশিক্ষিত কসাইয়ের সংখ্যা মাত্র ১ লাখের কাছাকাছি। চট্টগ্রাম শহরে প্রতি ঈদে কোরবানির পশুর সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যায়, যার জন্য পেশাদার কসাইয়ের চরম সংকট তৈরি হয় ।
ঈদের সময় অনেক পরিবারকে দেখা যায় আগে থেকে কসাই বুকিং করতে না পারায় ঈদের দিন কোরবানি দেওয়া সম্ভব হয় না। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে ঈদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে কোরবানি করেন, আবার কেউ মৌসুমি অদক্ষ কসাইদের দ্বারস্থ হন। এতে পশু জবাই ও মাংস প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রেও নানা সমস্যা দেখা দেয়।
চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার বাসিন্দা প্রবাস ফেরত আব্দুল কাদের বলেন, ‘দুই বছর পর দেশে এসে পরিবারকে নিয়ে ঈদ উদযাপন করবো ভেবেছিলাম। গরু আগেভাগেই কিনে রেখেছি। কিন্তু পেশাদার কসাই খুঁজে পাচ্ছি না। ১০–১২ জন কসাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, সবাই আগে থেকেই বুকড। এখন ভাবছি দ্বিতীয় দিন কোরবানি দিতে হবে। না হয় আশপাশের মানুষ ডেকে কাজ করাতে হবে।’
ব্যবসায়ী শওকত আলী বলেন, ‘গত বছর ঈদের দিন কসাই সংকটে পড়ে গেছিলাম। যাদের পেলাম, তারা এত বেশি পারিশ্রমিক চাইলো যে শুনে অবাক হলাম। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় দিন এক মৌসুমি কসাই দিয়ে কোরবানি দিলাম, কিন্তু ওর কাজে মাংসের প্রায় ১০ ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। এ বছর গরু কিনার আগে কসাই বুকড করেছি।’
শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেন বলেন, ‘বাবা বিদেশে থাকেন। সব দায়িত্ব আমার– গরু কিনে নেওয়া, কসাই ঠিক করা। এ বছর এখনও কসাই পাইনি। গত বছর গরু কিনেছি ঈদের দুই দিন আগে। ভাবছিলাম পাশের বাসার কসাই দিয়ে কোরবানি দিব। কিন্তু ঈদের সকালে দেখি সে আরেক জায়গায় বুকড। শেষ পর্যন্ত এক নতুন ছেলেকে দিয়ে কোরবানি করালাম, কিন্তু ও ঠিকভাবে কাটতে পারলো না। চামড়াটাও নষ্ট হয়ে গেল।’
ঈদ এলেই কসাইয়ের পারিশ্রমিক বেড়ে যায় কয়েকগুণ। বর্তমানে চট্টগ্রামে অনেক ক্ষেত্রে পশু প্রতি ১০–১৫ হাজার টাকা করে নেয়। গরু বড় হলে এভাবে হিসাব করে হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাজারমূল্যের প্রতি হাজার টাকায় ১৫০–২০০ টাকা হারে পারিশ্রমিক দাবি করে অনেকে। অর্থাৎ ৫ লাখ টাকার একটি গরুর কোরবানিতে কসাইয়ের পারিশ্রমিক দাঁড়াতে পারে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য এক বিশাল আর্থিক চাপ।
চট্টগ্রামে সাত বছর ধরে মৌসুমি কসাই হিসেবে কাজ করছেন জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ঈদের সময় শহরে কাজের চাপ অনেক বেশি। আমি চট্টগ্রামে ৭ বছর ধরে ঈদের মৌসুমে আসি। অনেকে বলে আমরা অভিজ্ঞ না, প্রশিক্ষণ পেলে আমরা আরও ভালো করতে পারতাম।’
অন্যদিকে পেশাদার কসাই নুরুল আমিন বলেন, ‘আমার মতে, ঈদের সময় কাজের জন্য আমাদের পারিশ্রমিক একটু বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন অনেকেই এই পেশায় না থেকেও মৌসুমিভাবে এসে কাজ করছে, যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। সরকার যদি আমাদের প্রশিক্ষণ দেয় ও লাইসেন্স ব্যবস্থা চালু করে, তাহলে মানুষের ভরসাও বাড়বে।’
এই সংকটের কারণে অনেক পরিবার ঈদের দিন কোরবানি দিতে পারে না। তারা বাধ্য হয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন পশু জবাই করেন। এতে ঈদের তাৎপর্য ও ধর্মীয় আনন্দে খানিকটা ভাটা পড়ে। অপরিকল্পিতভাবে কোরবানি দেওয়ার কারণে মাংস প্রক্রিয়াকরণেও সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। অনেক সময় চামড়া নষ্ট হয়ে যায়, মাংস কেটে রাখা হয় অনুপযুক্তভাবে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে নিয়মিত কসাই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা দরকার। প্রতি বছর ঈদের আগে ইউনিয়ন পর্যায়েও এ ধরনের প্রশিক্ষণ দিলে স্থানীয়রা এ কাজে দক্ষ হয়ে উঠবেন।
নগরবাসীর সুবিধার্থে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পেশাদার কসাই বুকিংয়ের সুবিধা চালু করা যেতে পারে। এতে নির্ধারিত পারিশ্রমিক ও কসাইয়ের অভিজ্ঞতা যাচাই করে বুকিং দেওয়া যাবে, যার ফলে প্রতারণা বা অদক্ষতার ঝুঁকি কমবে।
প্রশিক্ষিত স্থানীয় কসাইদের উৎসাহ দিয়ে এ পেশায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। প্রয়োজন হলে সরকারিভাবে প্রণোদনা ও উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ঈদের তিন দিনকে সমভাবে কাজে লাগাতে পারলে ঈদের প্রথম দিনে সৃষ্ট চাপ অনেকটাই কমানো সম্ভব। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এই ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য।
কোরবানি ঈদ শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবেও একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই উৎসবকে নির্বিঘ্ন ও সার্থক করতে কসাই সংকটের সমাধান জরুরি। সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, সামাজিক সংগঠন ও তরুণ উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার ঘটিয়ে এ সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব। তবেই কোরবানির ঈদ হবে সবার জন্য আনন্দময়, স্মরণীয় ও অর্থবহ।