সাধারণত পরিবার গঠন হয় একজন পুরুষ ও একজন নারীর সমন্বয়ে। সেই পুরুষ ও নারী যদি মহান আল্লাহতায়ালার বিধান মোতাবেক পরিবার গঠন করতে পারেন, তাহলে সেই পরিবারের সন্তান–সন্তুতি ও পৌত্রাদি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম আদর্শ পরিবার হিসাবে গড়ে উঠবে–এতে কোন সন্দেহ নেই। আর যদি আল্লাহর বিধান বিরোধী পরিবার গঠন করা হয়, তবে সেই পরিবার হবে কলঙ্কিত ও দূর্ভাগা। সেজন্যে আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কালামে পাকে ঈমানদার ও তাঁর পরিবারকে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। সূরা তাহরিমের ৬ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা নিজেদের এবং নিজেদের পরিবার পরিজনদের (জাহান্নামের সেই কঠিন) আগুন থেকে বাঁচাও, তার জ্বালানী হবে মানুষ আর পাথর, জাহান্নামের উপর প্রহরা যাদের উপর অর্পিত, সেই সব ফেরেশতা হচ্ছে নির্মম ও কঠোর, তারা আল্লাহর কোন আদেশই অমান্য করবে না, তারা তাই করবে যা তাদের করার জন্য আদেশ করা হবে’। অতএব পরিবারকে আল্লাহর নির্দেশমুখী ও রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাত অনুযায়ী পরিচালনা করার জন্য আদর্শ পরিবার গঠনের বিকল্প নেই। জাহান্নামের কঠিন আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অবশ্যই কোরআন–সুন্নাহ ভিত্তিক পরিবার গঠন অত্যাবশ্যক। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে একটি ব্যক্তিসত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন, ‘হে মানুষ, তোমরা তোমাদের মালিককে ভয় কর, যিনি তোমাদের একটি ব্যক্তিসত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতপর তিনি তা থেকে জুড়ি পয়দা করেছেন, তাদের থেকে তিনি বহু সংখ্যক নর–নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন’– সূরা আন নিসা–১। আল্লাহতায়ালা চারটি পদ্ধতিতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। প্রথম পদ্ধতিটি হচ্ছে– হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করেছেন কোন ধরনের নারী–পুরুষের সংমিশ্রণ ছাড়াই, দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে–হযরত হাওয়া (আঃ) কে সৃষ্টি করেছেন হযরত আদম (আঃ) এর দেহের একটি অংশ থেকে। তৃতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে–হযরত ঈসা (আঃ) কে সৃষ্টি করেছেন তাঁর কুদরতি শক্তির মাধ্যমে। চতুর্থ পদ্ধতিটি হচ্ছে– নারী–পুরুষের সংমিশ্রণের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি করেছেন আর এটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতেই থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহতায়ালা সূরা আরাফ এর ১৮৯ নং আয়াতে বলেছেন, ‘তিনিই আল্লাহতায়ালা, যিনি তোমাদের একটি প্রাণ থেকে পয়দা করেছেন এবং তা থেকে তিনি জুড়ি বানিয়েছেন, যেন তার কাছে পরম শান্তি লাভ করতে পারে’। সূরা আর রোম এর ২১ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাঁর নির্দশনসমূহের এও একটি যে, তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে (তোমাদের সঙ্গী–সঙ্গিনীদের বানিয়েছেন), যাতে করে তোমরা তাদের কাছে সুখ–শান্তি লাভ করতে পার, তিনি তোমাদের মাঝে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, আদম সন্তানের সৌভাগ্যের লক্ষণ ৪ টি। ১। নেককার স্ত্রী, ২। ভাল বাড়ি, ৩। ভাল গাড়ী, ৪। ভাল প্রতিবেশী-(মুসনাদে আহমদ – ১৪৬)। নেককার স্ত্রী হলে সংসারে সুখের বন্যা বয়ে যাবে, কেননা তখন পরিবারে একটি জান্নাতী পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ঘরটি কোরআনময় হয়ে উঠবে। নামাজের সময় নামাজ, পড়াশুনার সময় পড়াশুনা, খেলাধুলার সময় খেলাধুলা। অপ সংস্কৃতির কোন বালাই থাকবে না। নেককার স্ত্রী আপনাকে ফজরের নামাজের সময় ঘুম থেকে উঠিয়ে দিবেন, তাহাজ্জুদের সময় উঠিয়ে দিবেন, সৎকর্ম করতে আপনাকে বাধা দিবে না। আল্লাহর বিধান ও রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাত মানতে আপনাকে নিষেধ করবে না। ঘরের মধ্যে সালামের রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হবে, আল্লাহর জিকির– আজকারে মশগুল থাকবে সর্বদা। ইসলামী পাঠ্য পুস্তকের সমাহার থাকবে ঘরময়। ঝগড়া–ঝাটির কোন আভাস পাওয়া যাবে না। চিৎকার–চেঁচামেচির কোন শব্দ শুনা যাবে না, ঘরের মধ্যে সর্বদা আল্লাহার কোরআনের আয়াত শোনা যাবে। এই হচ্ছে আদর্শ পরিবার গঠনের কতিপয় টিপস। দুর্ভাগ্যের লক্ষণ ৪ টি। ১। বদকার স্ত্রী, ২। খারাপ বাড়ি, ৩। খারাপ গাড়ী, ৪। খারাপ প্রতিবেশী, বদকার স্ত্রী হলে আপনাকে ফজরের সময় ঘুম থেকে ডেকে তুলবে না, তাহাজ্জুদ তো দূরের কথা। আল্লাহর কোরআনের কোনো আওয়াজ শোনা যাবে না, জিকির–আযকার শোনা যাবে না। সব সময় জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী ও অন্যান্য অনুষ্ঠান নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকবে পরিবারের সদস্যরা–যেন জাহান্নামী পরিবেশের এক টুকরা আবহ পাওয়া যাবে এই ঘরগুলোতে। পরিবারের সদস্যগুলোর মাঝে সালামের কোন রেওয়াজ থাকবে না। রাত–বিরাতে ছেলে–মেয়েরা ঘরে ফিরলেও কোন জবাবদিহিতা থাকবে না। অন্যত্র একটি হাদীসে আল্লাহতায়ালা বলেন, কেউ যদি একজন নেককার বিবি জীবনসঙ্গীনি হিসাবে পায়, তবে তার ধর্ম পালন অর্ধেক হয়ে যায়। বাকী অর্ধেকের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় কর-(বায়হাকী–৪৪৭১)। অন্য একটি হাদীসে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, চারটি জিনিস থাকলে মানুষের জীবন হয়ে উঠবে সৌন্দর্যময় ও পুণ্যময়– ১। কল্ব– যেটা দিয়ে আল্লাহকে ভয় করা হয়, ২। জিহবা– যেটা দিয়ে আল্লাহর জিকির করা হয়, ৩। শরীর– যেটা বিপদের সময় ধৈর্য ধারণ করতে পারে, ৪। নেককার বিবি– যে নিজের ইজ্জত সংরক্ষণ করে– (তাবারানি–৭২১২)। সুনামি দারেবি–২২২৭ এর একটি হাদীসে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তোমরা নেককার ছেলে পেলে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দাও’। অবশ্যই সেই ছেলে হতে হবে ঈমানদার ও সৎ চরিত্রের অধিকারী। একটি সুন্দর ও আদর্শ পরিবার গঠনের নিমিত্তে আমাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর কোরআনকে বুকে ধারণ করতে হবে এবং রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাতকে জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়াতে হবে। একজন নেক্কার স্ত্রী পরিবারের জন্য অনেক বড় সম্পদ, একজন নেক্কার পুরুষ পরিবারের জন্য অনেক বড় সম্পদ। সে জন্যে আদর্শ পরিবার গঠনের পূর্ব শর্তই হচ্ছে: নেক্কার ছেলে ও নেক্কার মেয়ের বিবাহ বন্ধন। অবশ্যই তাদেরকে হতে হবে ঈমানদার ও সৎ চরিত্রের অধিকারী। তাহলেই তাদের ঘরে জন্মাবে হযরত আবু বক্কর (রাঃ) এর উত্তরসুরী, হযরত উমর (রাঃ) এর উত্তরসুরী, হযরত আলী (রাঃ) এর উত্তরসুরী, হযরত উসমান (রাঃ) এর উত্তরসুরী। ঐ সব নেক সন্তানেরা ধারণ করবে সাহাবীদের আদর্শ, তাবেঈ,তাবে–তাবেঈনদের আদর্শ, সালফে–সালেহীনদের আদর্শ। একজন নামাজী সন্তান পরিবারের জন্য অনেক বড় অর্জন ও একজন পর্দানশীন কন্যা সন্তান পরিবারের জন্য অনেক বড় অর্জন। অপসংস্কৃতির এই ভয়াবহ পরিবেশে আপনার ছেলে–মেয়েকে আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে তোলা আপনার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে সফল হতে পারলেই আপনি একজন সুখী মানুষ। আল কোরআনের সেই আয়াতটি বার বার দৃশ্যপটে ভেসে আসে, ‘হে আমার রব, তুমি আমাকে নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী বানাও, আমার সন্তানদের মাঝ থেকেও নামাজী বান্দা বানাও, হে আমাদের রব, আমার দোয়া তুমি কবুল কর’– সূরা ইব্রাহীম– আয়াত– ৪০।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল