পুরো পৃথিবী ইতিহাসের ভয়ঙ্কর বাঁক পার করছে। সময়স্রোতের টানে খৃষ্টীয় বা গ্রেগেরিয় ২০২০ সালের বর্ষপঞ্জি মুছে যাবে কদিন পর। দরজায় অপেক্ষা আছে ২০২১। বিগত নববর্ষগুলোর মত পৃথিবীর নানা দেশে এবারের নববর্ষ নিয়ে উম্মাদনা আর উচ্ছ্বাসের সুনামি বইবে না, এটা নিশ্চিত। বড়দিনে তথা মেরি ক্রিসমাস উৎসব তার ইঙ্গিত দিয়ে গেছে। আনন্দ উচ্ছ্বাসের বদলে ইউরোপ এবং খৃষ্টান অধ্যুষিত দেশগুলোতে আনন্দ আয়োজন ছাঁটাই করে গীর্জায় প্রার্থনা সভার উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবারের বড়দিনের উৎসবকে। গীর্জায় গীর্জায় মানবজাতিকে কোভিড-১৯ এর মত অতিমারির কবল থেকে রক্ষার জন্য প্রার্থনা করেন খৃষ্টান ধর্মগুরুরা।
এরমাঝে ইংল্যান্ড বিশেষ করে রাজধানী লন্ডনে নতুন চরিত্রের কোভিড-১৯ ভাইরাসের হামলা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে সংক্রমণের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বন্ধুদেশ যুক্তরাষ্ট্রেসহ ইউরোপ এবং আরো বহু দেশ ইংল্যান্ডের সাথে সব ধরনের বিমান যোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ইংল্যান্ড থেকে ইতালি ফ্রান্সেও নতুন ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে। ফাইজার বায়োএনটেক আবিষ্কৃত ভ্যাঙিন প্রয়োগ ১৫ ডিসেম্বর থেকে ইংল্যান্ডে শুরু হয়। এ’পর্যন্ত ৮০ বছরের বেশি বয়সী প্রায় হাজার ব্যক্তিকে ভ্যাঙিন প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু ভাইরাসটির চরিত্র বদল ও হামলার অস্বাভাবিক তীব্রতা পুরো বিশ্বকে বিস্মিত করে দিয়েছে। কেন এমন হচ্ছে, প্রশ্নের জবাব নেই। কভিড-১৯ এর কোন কার্যকর ওষুধও ২০২০ সালে আসেনি। কোভিড-১৯ এর বছরব্যাপী আক্রমণ পুরো বিশ্ব অর্থনীতি এমনকী রাজনীতিকেও নাজুক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি বিশেষ করে বিমান পরিষেবা, পর্যটনসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ খাত পুরোই ধুঁকছে। দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশেও এর প্রভাব বিশাল। নতুন বছরে কোভিড-১৯ আয়ত্তে না আসলে অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় এর ফলাফল কী হবে,পূর্বাভাস দেয়া অসম্ভব।
আমরা জানি, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে মহামারি অতিমারির হামলা হয়েছে। অসংখ্য জনপদ রাতারাতি মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। প্লেগ, কলেরা, জলবসন্ত, কালাজ্বরে আমাদের উপমহাদেশেও লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। বর্ধিষ্ণু জনপদ রাতারাতি বিরান ভূমি হয়ে গেছে। তখন এসব মহামারির কোন চিকিৎসা বা প্রতিষেধক ছিল না। তাই আক্রান্ত হওয়া মানেই ছিল মৃত্যু।
কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন অনন্য উচ্চতায়। হাড়গোড়সহ হৃদপিন্ড, কিডনি, লিভার, ফুসফুস পর্যন্ত পুনঃস্থাপন এখন জটিল কিছু না। ফাইবার তন্তু দিয়ে মানব প্রত্যেঙ্গও তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে মানব জীবনকে অনেক সহজ ও স্বচ্ছন্দ করে দিয়েছে। গড় আয়ু কোন কোন উন্নত দেশে এখন শত বছরের কাছাকাছি। আমাদের দেশও ঔপনিবেশিক আমলের ২৭ বছর গড় আয়ু থেকে উন্নীত হয়ে এখন ৭৪ বছর। এসব উন্নয়ন এক কথায় অবিশ্বাস্য। অতি বিরল ছাড়া সব রোগের ওষুধ এখনতো হাতের কাছেই। কিন্তু ব্যতিক্রম করোনা। ২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনে রোগটি প্রথম সনাক্ত হয়। পরে চীন ছাড়িয়ে ২০২০ সালে পুরো পৃথিবী দাপাচ্ছে কোভিড-১৯ ভাইরাস নামের অতিমারি রোগটি। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৮ কোটির উপরে। মৃত্যুর সংখ্যা দেড় মিলিয়নের কাছাকাছি। এক বছরের বেশি সময়ে রোগটির কার্যকর ওষুধ আসেনি। প্রতিষেধক শেষ মুহূর্তে আবিষ্কৃত হলেও ভাইরাস দ্রুত চরিত্র পাল্টাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য অগ্রযাত্রাকে জবরদস্তি থামিয়ে দিয়েছে করোনা! পুরো ২০২০ সাল পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে ছেলেখেলা করেছে ভাইরাসটি। কভিড-১৯ এর প্রধান উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। রোগির অঙিজেন স্যাচুরেশন কমে গেলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বাড়তি অঙিজেন প্রয়োগ করে স্যাচুরেশন স্বাভাবিক করা হয়। শ্বাসকষ্ট কত যন্ত্রণার, যারা মৃত্যুর গুহা থেকে ভাগ্যক্রমে ফিরেছেন একমাত্র তারাই জানেন। হাসপাতাল ও রোগির অবস্থানভেদে অঙিজেন কিনতে ঘন্টায় ২০০ থেকে হাজার টাকা খরচ হয় একজনের। দিনের হিসাবে প্রায় ৫ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকা। অথচ সুস্থ অবস্থায় আমৃত্যু ফ্রি পেয়ে যাচ্ছি জীবনদায়ী অঙিজেন। যার মূল্য হাজার হাজার কোটি টাকা! প্রশ্ন উঠেছে, কোভিড-১৯ ভাইরাস কী প্রকৃতির প্রতিশোধ? অনেক প্রকৃতি বিজ্ঞানীও তাই বলছেন। প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ আমরা পুরোই দুষিত করে ফেলেছি। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা, ওজোন স্তরের ক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা মেরামত মানুষের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। ভোগবাদের জঞ্জাল আধুনিক ও বিলাসবহুল গেজেট, সাজসরঞ্জাম, প্রকৃতি বিনাশ, বেপরোয়া পাহাড়, বৃক্ষ নিধন, প্রাকৃতিক জলাধারসহ পুকুর দিঘি ভরাট করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ছিন্নভিন্ন করে আমরা নিজেদের কবর খনন করেছি। এর প্রথম বিষফল, কোভিড-১৯ এর মত অজেয় ভাইরাস। স্বাভাবিক কারণে ২০২০ সাল পুরোই কোভিড-১৯ এর দখলে ছিল। ২০২১ সালে কী ঘটবে বা আসবে তা এখনো ভবিষ্যতের গোপন পকেটে। জ্যোতিষ মহারাজ সম্রাটের সাল গণনায় এর কোন প্রভাব পড়বেইনা।
বিস্ময়কর বটেই: এদিকে ২০২১ সাল নিয়ে নেটিজেনদের মাঝে দারুণ হৈচৈ শুরু হয়েছে। কারণ এটা আমাদের আবেগ। ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে টানা ন’ মাসের মুক্তিযুদ্ধে মুক্ত ও স্বাধীন দেশ উপহার পাই। ৩০ লাখ শহীদ ও তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের দামে স্বাধীনতার সোনালি সূর্য ছিনিয়ে এনেছি আমরা। বিস্ময়করভাবে ১৯৭১ এর বর্ষপঞ্জি আর ২০২১ সালের বর্ষপঞ্জি হুবহু মিলে গেছে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির জন্য এটাও এক নবতর উপহার অবশ্যই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, গল্পকার