কোভিড ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বাঁচবে জীবন

অধ্যাপক জাহাঙ্গীর চৌধুরী | রবিবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে দিন দিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস এখন মহামারি হয়ে উঠছে। সারা বিশ্বে এটি একটি আতঙ্কের নাম হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এই রোগীর সংখ্যা অর্ধ কোটির উপরে। বছরে বাড়ছে আরো ১ লাখ রোগী। আগামী ২০ বছরে এ সংখ্যা পৌঁছবে ১ কোটি ২০ লাখে। বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে ৫৭ শতাংশ লোক জানেনা যে তার ডায়াবেটিস রোগ আছে। বছরে এই রোগে প্রায় ১ লাখ লোক মারা যাচ্ছে।
আান্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসাব মতে, ২০১৯ সালে প্রতি ১১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল (মোট ৪২৫ মিলিয়ন); ২০৪৫ সালে ৪৮ শতাংশ বেড়ে তা ৬২৯ মিলিয়ন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পৃথিবীর মোট ডায়াবেটিস রোগীর ৮৭ শতাংশই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে।
বাংলাদেশে যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ২০১৯ সনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে ১০ম স্থানে ছিল। কিন্তু আরো ভয়াবহ হলো ২০৩০ ও ২০৪৫ সনে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে থাকবে। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে উচ্চহারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে খুব দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক ও কাঙ্ক্ষিত হারের চেয়ে বেশি, মানুষের দৈহিক শ্রম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানসিক চাপ বেড়েছে অনেকগুণ।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ডায়াবেটিস এমন এক রোগ, স্বাস্থ্য শিক্ষাই যার প্রধান চিকিৎসা। যথাযথ স্বাস্থ্য শিক্ষা পেলে একজন ডায়াবেটিক রোগী চিকিৎসকের ওপর নির্ভর না হয়ে এ রোগ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিস এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। ডায়াবেটিস সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করছে অসংখ্য মানুষ।
ডায়াবেটিস ও করোনা : ডায়াবেটিস করোনায় মৃত্যু হার বাড়াচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ক্রমশ ত্রাস হয়ে উঠছে এই কোভিড-১৯। আন্তর্জাতিক সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, হাসপাতালে ভর্তির সাতদিন পর প্রতি ১০ করোনা রোগীর মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে এই ডায়াবেটিসের কারণেই। আর প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনকে ইনটিবেটেড অ্যান্ড মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনে দিতে হচ্ছে। এর উপর যদি মাইক্রো ভাসকুলার জটিলতা থাকে তাহলে মৃত্যুর ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
চিকিৎসকরা আগেই সতর্ক করেছিলেন, ডায়াবেটিস থাকলে করোনা আক্রান্ত হলে সমস্যা বাড়ে। এক সমীক্ষায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গত ১০-৩১ মার্চের মধ্যে ফ্রান্সের ৫৩টি হাসপাতালের ১ হাজার ৩১৭ জন রোগীর উপর পরীক্ষা চালান নানতেস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তাঁদের দাবি, করোনা আক্রান্ত ৯০ শতাংশ রোগীদের মধ্যে তাঁরা টাইপ ২ ডায়াবেটিস খুঁজে পেয়েছেন। আরও তিন শতাংশ রোগীর দেহে মিলেছে টাইপ ১ ডায়াবেটিস। করোনায় যতজন রোগী আক্রান্ত হয়েছে তন্মধ্যে ৬০% ডায়াবেটিস রোগী।
ডায়াবেটোলোজিয়া জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দুই তৃতীয়াংশই পুরুষ। তাঁদের গড় আয়ু ৭০ বছরের মধ্যে। তা দেখে গবেষকরা বলছেন, অধিক বয়স ও ডায়াবেটিসের কারণেই অধিকাংশ করোনা রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সাতদিনের মধ্যে এই ধরনের রোগীর শারীরিক অবনতি হচ্ছে। ভেন্টিলেশনে পাঠাতে হচ্ছে তাঁদের। আর তাঁদের প্রতি দশ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। আশঙ্কার কথা হল, এই ধরনের মাত্র ১৮ শতাংশ রোগী বাড়ি ফিরতে পারছেন।
ডায়াবেটিস ও পায়ের যত্ন : মানব শরীরের প্রায় সর্বাঙ্গে জটিলতা সৃষ্টিকারী এক রোগের নাম ডায়াবেটিস। তেমনি ডায়াবেটিসের জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নাম পা, বিশেষত পায়ের পাতা। মূলত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা যথাযথ নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে পায়ের ধমনির প্রাচীর ক্রমান্বয়ে হতে থাকে পুরু, সঙ্কীর্ণ হতে পারে রক্ত চলাচলের পথ, ব্যাহত হয় আক্রান্ত অঙ্গে যথাযথ রক্ত সরবরাহ। সেই সাথে পায়ের স্নায়ুকলা আক্রান্ত হয়ে লুপ্ত হয় বোধশক্তি, কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে পায়ের নাড়াচাড়া। তা ছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে অকার্যকর হয়ে পড়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। দেখা দেয় আক্রান্ত পায়ে ক্ষতসহ নানা রোগজীবাণুর সংক্রমণ। পায়ের অস্থিসন্ধিগুলোর স্বাভাবিক গঠনে দেখা দেয় বিকৃতি। আক্রান্ত পায়ের ঘা সহজে শুকাতে চায় না। ফলে সহজেই আক্রান্ত পা থেকে জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে পায়ের গভীর কোষকলাসহ সমস্ত শরীরে।
কিভাবে বুঝবেন আপনার পা ডায়াবেটিসের জটিলতায় আক্রান্ত?
আপনি যদি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন এবং আপনার পায়ে নিম্নলিখিত এক বা একাধিক সমস্যা দেখা দেয়, যেমন-
– আক্রান্ত পায়ে দেখা দিতে পারে অস্বাভাবিক অনুভূতি বা ঝিমঝিম ভাব,- পায়ে অনুভূতিহীনতা,- পায়ের নড়ন ক্ষমতা লুপ্ত হওয়া, পায়ে ব্যথা, – হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা বা অবসাদ, – পায়ে ঘা হওয়া, – আক্রান্ত পা বা পায়ের অস্থিসন্ধি হঠাৎ লাল হয়ে ফুলে যাওয়া, – দীর্ঘ পর্যায়ে দেখা যেতে পারে পায়ের ঘায়ে জীবাণুর সংক্রমণ, – আক্রান্ত পায়ে ফোড়া ও পায়ের অস্থিতে জীবাণুর সংক্রমণ, – পায়ের অস্থিসন্ধির বিকৃতি, – পায়ের আঙুল এমনকি সমস্ত পায়ে ধরতে পারে পচন, – রোগের জটিল পর্যায়ে পায়ের ক্ষত থেকে রোগজীবাণু সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়া। তখনই বুঝবেন আপনার পা ডায়াবেটিসের জটিলতায় আক্রান্ত।
ডায়াবেটিস ও কিডনী রোগ : ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যেটি শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করতে পারে বিশেষত যদি ব্লাড সুগার অনেকদিন অনিয়ন্ত্রিত থাকে। তার মধ্যে স্নায়ূর রোগ (ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথি), চোখের অসুখ (ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি), কিডনির অসুখ (ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি), হৃদরোগ (পক্ষাঘাত বা ষ্ট্রোক) এবং ডায়াবেটিস ফুট অন্যতম। এগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিসজনিত কিডনির অসুখ বা ডায়াবেটিস কিডনি ডিজিজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্রনিক মরবিডিটি এবং মরটালিটি অর্থাৎ দীর্ঘ মেয়াদি অসুস্থতা এবং মৃত্যু। শুধু তা-ই নয়, ডায়াবেটিস কিডনি ডিজিজকে ডায়াবেটিসের একটি অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ জটিলতা হিসাবে গণ্য করা হয়। কারণ এই ধরনের কিডনির অসুখের চিকিৎসা অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৬ শতাংশ রোগী কিডনির অসুখে আক্রান্ত হন।
ডায়াবেটিসের কারণে কিডনির যে জটিলতা হয় সে বিষয়ে জনসাধারণের মনে একটা ভয়ের স্থান রয়েছে। এই ভয়, কিন্তু একেবারেই অমূলক নয়। যে পরিবারের একজন সদস্য এই কিডনির সমস্যায় ভুগছেন সেই পরিবারের অন্যান্যরাও এটির মর্ম বুঝবেন। বলা হয়, একজন কিডনি ফেলিওরের রোগী ধনেপ্রাণে মারা যান এবং পরিবারস্থ অন্যদেরও চরম বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেন। কারণ কিডনি ফেলিওরের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এর সুযোগ-সুবিধাও আমাদের দেশের শহরের বড় হাসপাতাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সৌভাগ্যবান কতিপয় যাঁরা ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের সুযোগ পান তাদের মধ্যেও ৭৫ শতাংশ মানুষ মারা যার চার বছরের মধ্যে। মূলত হৃদরোগ বা ওই ধরনের কোনও জটিলতার কারণে।
মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা আছে, যে কিডনি ফেলিওর হতে শুরু করলে বুঝি একটি কিডনি অকেজো হয় এবং অন্যটি দুটির সমান কাজ চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ বা এই ধরনের কোনও কারণে কিডনি আক্রান্ত হলে দুটি কিডনি একই সঙ্গে প্রভাবিত হয়। সুতরাং একবার কিডনি ফেলিওর হলে যদি ওষুধে কাজ চালানো না যায় তাহলে ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে আশার কথা এই যে, সব ডায়াবেটিসের রোগী কিডনির জটিলতায় আক্রান্ত হন না এবং সারা বিশ্বে সমীক্ষার মাধ্যমে আজ প্রমাণিত যে, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের সুচিকিৎসার ফলে কিডনি ফেলিওর প্রতিহত করা প্রায় পুরোপুরি সম্ভব। কিন্তু তার জন্য চাই সচেতনতা রোগী থেকে চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এমনকী সমাজের সর্বস্তরে এই সচেতনতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগী বাড়ছে। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও আনুমানিক ৫০ লাখ লোক এই রোগে আক্রান্ত। গ্রামের চেয়ে শহরে ডায়াবেটিসের রোগী বেশি। বহুবিধ কারণে এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে জীবনযাত্রার পরিবর্তন, নগরায়ন, শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া ইত্যাদি। বছরে এই রোগে প্রায় এক লাখ লোক মারা যাচ্ছে।
পরিশেষে বলতে চাই, কোভিড থেকে বাঁচতে হলে যেমন সচেতনতা প্রয়োজন তেমনি ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতেও সচেতনতা প্রয়োজন। একমাত্র সচেতনতাই পারে কোভিড ও ডায়াবেটিসকে প্রতিহত করতে।

লেখক : সভাপতি, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসাংবাদিক-অ্যাক্টিভিস্ট নিপীড়নে নতুন ভিসা নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের