‘যাকে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে তার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে দলের মনোনয়ন বঞ্চিতসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের।’– আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ নির্বাচনে দলের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করার আগে এ ঐক্যের বার্তা দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান। একইসঙ্গে প্রার্থী ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দলের সাংগঠনিক ঐক্য যাতে বিনষ্ট না হয় সেজন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা। এতকিছুর পরও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কোন্দলের অনলে পুড়ছে সেই ঐক্য। বিশেষ করে চট্টগ্রাম–১৫ (সাতকানিয়া–লোহাগাড়া) আসনে এ অনৈক্য স্পষ্ট।
জানা গেছে, গত ৪ ডিসেম্বর দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নাজমুল মোস্তফা আমিনকে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চট্টগ্রাম–১৫ আসনে দলের প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেন ও মুজিবুর রহমান রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
জামাল হোসেন ও মুজিবুর রহমানের দাবি, রিভিউ করে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দল প্রার্থী পরিবর্তন করতে পারে। সেক্ষেত্রে দলের জন্য ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে। তারা বিএনপির দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন। প্রার্থী পরিবর্তন করলে তারা আশাবাদী। তাছাড়া তাদের অভিযোগ, দল মনোনয়ন দেয়ার বেশ কয়েকদিন পর নাজমুল মোস্তফা এলাকায় গেছেন। দল সেটাও আমলে নিতে পারে শেষ পর্যন্ত। তবে নাজমুল মোস্তফা বলছেন, মনোনয়ন দেয়ার পর তিনি সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ার বিএনপি নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন। এমনকি জামাল হোসেন ও মুজিবুর রহমানের সাথেও যোগাযোগ করেছেন।
এদিকে চট্টগ্রাম–১৫ আসনের বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা বলছেন, নাজমুল মোস্তফাকে প্রার্থী করার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২৯ বছর পর আসনটিতে নিজ দলের কর্মীকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী করছে বিএনপি। তাই দলের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিতে ঐক্য ধরো রাখা উচিত।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ফৌজুল কবির ফজলু আজাদীকে বলেন, দীর্ঘ বছর পর সাতকানিয়া লোহাগাড়া–আসনে ধানের শীষের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যাকে দল মনোনীত প্রার্থী দিয়েছে তিনি অত্যন্ত সৎ যোগ্য ও বিগত সময়ে আন্দোলন–সংগ্রাম করতে গিয়ে অনেক অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলেই দল তাকে মূল্যায়ন করেছে। তৃণমূল এই আসনটি প্রিয় নেতা তারেক রহমানকে উপহার দিতে চাই।
অভিযোগ নিয়ে যা বললেন নাজমুল মোস্তফা : নাজমুল মোস্তফা আমিন আজাদীকে বলেন, আমাদের মধ্যে ঐক্য নেই বলা যাবে না। কৌশলগত কারণে ওনারা ফরম নিয়েছেন। যদি কোনো কারণে একজনেরটা বাতিল হল, তখন আরেকজন থাকলে দলের টেনশন থাকল না। এটা তো স্বাভাবিক বিষয়, বিভিন্ন আসনে এমন হয়। এটার মধ্য দিয়ে ঐক্য বিনষ্ট হয় না। তাছাড়া ইতোপূর্বে আমরা সবাই দলের হাই কমান্ডের কাছে কমিটমেন্ট করেছি যাকে মনোনয়ন দেবে তার জন্য সবাই কাজ করব। তারাও একসাথে কাজ করার জন্য কমিটমেন্ট করেছে। তাদের সাথে কথা বলেছি, তারা ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখবেন বলেছেন। এরপরও তারা যদি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে সেক্ষেত্রে দলের হাইকমান্ড তার দায়িত্বের জায়গা থেকে বিষয়গুলো ঠিক করে দেবেন।
‘দলের প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়ার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও এলাকায় না যাওয়া’র অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যেকের তো নিজস্ব কৌশল থাকে। কেউ সাতদিন, কেই ১৫ দিন পরে গেছে এমনও আছে। আমাকে দল মনোনয়ন দেয়ার আমার পরিকল্পনা ছিল, তাদের সাথে নিয়ে একসাথে যাব। যদি মনোনয়ন পাওয়ার পরদিন যেতাম তখন তারা বলতেন, আমি তাদের সঙ্গে কথা বলিনি, যোগাযোগ করিনি সাথে নিয়ে যাইনি। তাই এই ধরনের কোনো অভিযোগ যেন আমার বিরুদ্ধে আনতে না পারে সে জন্য আমি মাঝখানে ছয়দিন সময় নিয়েছি। এই ছয়দিন আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করেছি এবং তাদের বাসায়ও গেছি। তাদের সাথে যেন বন্ধন তৈরি হয় সেজন্য সময় নিয়েছি। আমার পরিকল্পনা ছিল, সবাইকে সাথে নিয়ে যৌথভাবে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড শুরু করব এবং ধানের শীষের জন্য মানুষের কাছে যাব। এরপরও এখানে আমার কোনো ভুল–ত্রুটি হয় সে বিষয়ে কেন্দ্র আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে পারে, অন্য কেউ না।
উল্লেখ্য, দলের মনোনীত প্রার্থী নাজমুল মোস্তফা আমিন ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শ্রমিকদলের আহ্বায়ক ও শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। লোহাগাড়া উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি ও আহ্বায়ক এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা দিলেন তারা : জামাল হোসেন আজাদীকে বলেন, যাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তিনি আন্দোলন–সংগ্রামে ছিলেন না। সাতকানিয়ার কোনো ইউনিয়ন এবং পৌরসভায়ও আসেননি কখনো। লোহাগাড়ায়ও উনি কাজ করেননি। নির্বাচন করার ইচ্ছে থাকলে তো ওনার উচিত ছিল সাতকানিয়া–লোহাগাড়ায় আসা। আমি লোহাগাড়ার প্রতিটি ইউনিয়নের পাশপাশি সাতকানিয়ায়ও গেছি, এমন কোনো ইউনিয়ন নেই যেখানে আমি মিটিং করিনি। পৌরসভায়ও কাজ করেছি। আন্দোলন–সংগ্রামেও ছিলাম। ২৫ ডিসেম্বর আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন আসবেন, তিনি একটা সিদ্ধান্ত দেবেন। সেক্ষেত্রে আমি আশাবাদী, যেহেতু দলের জন্য অতীতে কাজ করেছি, সেই কাজের মূল্যায়ন করা হবে। ‘শেষ পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করার পরিকল্পনা আছে কিনা’ জানতে চাইলে বলেন, দলের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে কোনো নির্বাচন করবো না।
উল্লেখ্য, ছাত্রদলের কর্মী ছিলেন জামাল হোসেন। এছাড়া সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এবং বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপির দায়িত্বে ছিলেন।
মুজিবুর রহমান আজাদীকে বলেন, দল তো রিভিউ করতে পারে, এখনো পরিবর্তন করার সময় আছে। দল তো সেই অপশন রেখেছে। দলের দীর্ঘ আন্দোলন–সংগ্রামে ছিলাম। ১৯৮৮ সালে ছাত্রদল দিয়ে শুরু, তখন থেকে মাঠে আছি। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানও ছিলাম। সবমিলিয়ে এগিয়ে আছি। দল নিশ্চয়ই এগুলোর মূল্যায়ন করবে, তাই আমি আশাবাদী।
তিনি বলেন, যাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তিনি এর বেশ কয়েকদিন পর এলাকায় যান। এখনো দলীয় কোনো মিছিল–মিটিং, সভায়ও নেই তিনি। মাঠ ও জমাতে পারেননি। তাই সবমিলিয়ে কেন্দ্র পরিবর্তন করবে, ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য, মুজিবুর রহমান দক্ষিণ জেলা ছাত্র দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে দক্ষিণ জেলা বিএনপির স্ব–নির্ভর বিষয়ক সম্পাদক, সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
আসন সম্পর্কিত : সাতকানিয়ার ১১টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা, লোহাগাড়ার ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম–১৫ আসনটি গঠিত। বিগত ১টি সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির প্রার্থী তিনবার করে জয়লাভ করেছেন। আওয়ামী লীগ তিনবার ও জাতীয় পার্টি জিতেছে দুইবার।
প্রথম সংসদ নির্বাচনে এ আসনে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের এম সিদ্দিক। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী, তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ইব্রাহিম বিন খলিল, পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর শাহজাহান চৌধুরী, ষষ্ঠ ও সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম, অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর শাহজাহান চৌধুরী, নবম সংসদ নির্বাচনে আ ন ম শামসুল ইসলাম, দশম সংসদ ও একাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী বিজয়ী হন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের আবদুল মোতালেব।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম। কিন্তু শেষ মুর্হূতে বিএনপি সমর্থন করে শরীক দল জামায়াতে ইসলামীর শাহাজাহান চৌধুরীকে।












