কোনো সেনা সদস্য গুমে জড়িত থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা : সেনা সদর

সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সকল ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত

| শুক্রবার , ৪ জুলাই, ২০২৫ at ৪:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বিগত সরকারের সময়ে গুমের ঘটনায় সেনাবাহিনীর কোনো সদস্যের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সেনা সদরদপ্তর। মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য ডেপুটেশনে থাকেন, তারা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকেন না। ডেপুটেশনে থাকা কিছু সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, সেগুলোর তদন্ত চলমান রয়েছে। খবর বিডিনিউজের।

এই তদন্তে যদি গুমের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলে অবশ্যই সেনাবাহিনী তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে বাংলদেশ সেনাবাহিনী সব ধরনের সহযোগিতা করেছে এবং ভবিষ্যতেও সহযোগিতা থাকবে। ভুক্তভোগী কোনো পরিবার সহযোগিতা চাইলে, তাদেরও সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন এই সেনা কর্মকর্তা।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে গতবছর অগাস্টে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে সরকার। ‘গুমের’ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর মধ্যে কার কী ভূমিকা ছিল, তা গত ৪ জুন জমা দেওয়া কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।

সেখানে বলা হয়, গুমের বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। গুমের শিকার ব্যক্তি, তার পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশ, র‌্যাব এবং পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে ‘মূল অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

এর বাইরে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) অধিদপ্তর ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার ‘সত্যতা’ পাওয়ার কথা বলেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই বিভিন্ন ‘ব্ল্যাক সাইট’ পরিচালনা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত হচ্ছে ‘আয়নাঘর’, যেখানে বন্দিদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রেখে চরম নির্যাতন চালানো হত। বিগত সরকারের আমলে ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া এরকম তিনটি গোপন বন্দিশালা গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঘুরে দেখেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

জাতিসংঘের ‘গুম’ বিষয়ক কার্যনির্বাহী দলের (ডব্লিউজিইআইডি) ভাইস চেয়ারপারসন গ্রাজিনা বারানোভস্কারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকারউজজামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে গ্রাজিনা বারানোভস্কা বিভিন্ন সংস্থায় (যেমন র‌্যাব, ডিজিএফআই, বিজিবি) অতীতে কর্মরত কিছু সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জবাবে সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, এ ধরনের সেনা সদস্যরা ‘সংশ্লিষ্ট সংস্থার অধীনে নিয়ন্ত্রণাধীন থেকে’ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিচার প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তদন্ত প্রক্রিয়ায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। পরে ১৯ জানুয়ারি গুম সংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশনের এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ডিজিএফআই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। ডিজিএফআই সরাসরি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে রিপোর্ট করে। সাধারণত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বটি পালন করে থাকেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থাৎ ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অধীনে পরিচালিত হচ্ছিল।

এনএসআই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে পরিচালিত হত, যদিও তারা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। এটা ঠিক ইন্সটিটিউশনালি আর্মি রেসপন্সিবল না। এটা সত্য। কিন্তু ডিজিএফআইয়ের অফিসাররা, এনএসআইয়ের অনেক অফিসার, বিশেষ করে র‌্যাবের যারা কমান্ডিং অফিসার, র‌্যাবের এডিজি অপস যিনি থাকতেন তারা কিন্তু আর্মির অফিসার। এই অফিসাররা র‌্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই এ ডেপুটেশনে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। বেসিক্যালি তারা আর্মড ফোর্সের অফিসার, তারা সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী বা নৌবাহিনীর হতে পারেন। তাদের কমান্ডটা ডিফরেন্ট।

এসময় গুম সংক্রান্ত কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, তবে তারা জানত না এটা বলার সুযোগ নেই। কারণ তাদের একজন সাবেক সেনাপ্রধান পাবলিকলি বলেছেন যে, দুজন সেনাসদস্য তার কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন, তারা এই ধরনের কাজগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে চান না। একজন সাবেক সেনাপ্রধান এই স্টেটমেন্ট দেওয়ার পরে তারা জানত না এই কথা বলার সুযোগ নেই। তবে অফিসিয়ালি ইনভলভ ছিল না।

এ সময় চেয়ারম্যান বলেন, অ্যাজ আ ইন্সটিটিউশন তারা (সেনাবাহিনী) অফিসিয়ালি ইনভলভ ছিল না।

নির্বাচন প্রসঙ্গ : এদিকে সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল শফিকুল ইসলাম দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মাঠ পর্যায়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গত বছর জুলাই অগাস্ট আন্দোলন চলাকালে থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্র লুট হয়, যার ৮০ শাতাংশ এরইমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই সময় প্রায় ১২ হাজার অস্ত্র লুট হয়েছে। এর মধ্যে ৯ হাজারের বেশি অস্ত্র শুধু সেনাবাহিনী উদ্ধার করেছে। আগামী নির্বাচনের পূর্বে যতদূর সম্ভব বাকি অস্ত্র উদ্ধারে সেনাবাহিনী তৎপর রয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গও সংবাদ সম্মেলনে আসে। সেনাবাহিনী কি ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে জানতে চাইলে কর্নেল শফিকুল বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। পাওয়া মাত্র অবাধ, সুষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সকল ধরনের সহায়তা দিতে আমরা প্রস্তুত আছি। কথিত জনতার মাধ্যমে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাকে হেনস্তা করার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে সংবাদ সম্মেলনে।

জবাবে কর্নেল শফিকুল বলেন, এই ঘটনার পর আমরা পরের দিনই একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করি। এরপরে যদি কেউ জামিন পেয়ে যায়, তাহলে সেনাবাহিনীর কিছু করার থাকে না। এ ধরনের ঘটনায় সেনাবাহিনী ‘সব সময় সোচ্চার’ বলে মন্তব্য করেন এই সেনা কর্মকর্তা। বৃহস্পতিবার ভোরে বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে সেনা অভিযানে পাহাড়ি সংগঠন কেএনএফ’এর দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনাটিকে ‘বড় সাফল্য’ হিসাবে দেখছে সেনাবাহিনী।

এ ঘটনা পাহাড়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে মন্তব্য করে কর্নেল শফিকুল বলেন, কেএনএফের ভয়ে যেসব বম পরিবার চলে গিয়েছিল, তারা ফিরে আসতে শুরু করেছে। ১৩৮জন তাদের বসত ভিটায় ফিরে এসেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাতুনগঞ্জে আবারও বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ার নতুন ওসি যুযুৎসু চাকমা