কোনো ব্যক্তির ভিশন বা কোনো গোষ্ঠীর মিশনের ভিত্তিতে নয়, বাংলাদেশের জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সংস্কার হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এখন যারা সংস্কারের কথা বলেন, তাদের কাছে কোনো ম্যান্ডেট আছে? তাদের পক্ষে কার সমর্থন আছে? তাদেরকে কে বলেছে? হ্যাঁ, প্রণয়ন করুন, কমিশন হয়েছে, ভালো কথা। এগুলো সব আমরা আগামী সংসদে প্রস্তাব আকারে উপস্থাপন করব। আপনারা কষ্ট করে করেছেন, অনেক ধন্যবাদ।
গত শুক্রবার বিকালে নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে অমর একুশে বইমেলা মঞ্চে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, সহ–সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, কেন্দ্রীয় বিএনপির শ্রম সম্পাদক এ এম নাজিম উদ্দীন, নগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইদ্রিছ মিয়া ও সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
আমীর খসরু বলেন, সংস্কারের গল্প আমাদেরকে বলার দরকার নেই। এই গল্প যারা নতুন নতুন সংস্কার শিখেছে, তাদের মধ্যে আর আপনাদের মধ্যে রেখে দিন। বিএনপির ৩১ দফার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ৩১ দফা সংস্কার আকাশ থেকে পড়েনি। এটি প্রণয়নের পেছনে অনেক বিতর্ক, আলোচনা ও প্রস্তাবনা এসেছে। সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমরা ৩১ দফা প্রণয়ন করেছি। বাংলাদেশের মানুষের আগামী দিনের পরিবর্তনের বার্তা এই ৩১ দফার মাধ্যমেই দেওয়া হয়েছে। এই বার্তা নিয়ে আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি এবং সংস্কারের জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
তিনি বলেন, ৩১ দফার জন্য আমাদের জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণ যখন এসব দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ভোট দেবে, তখন আমরা এটি বাস্তবায়ন করতে পারব। তিনি বলেন, ৩১ দফা সংসদে আলোচনা হবে। আমরা বলেছি, হয়ে যাবে, তা নয়। সংসদে আলোচনা হবে। অন্য কোনো দলের যদি কোনো প্রস্তাব থাকে, সেটাও সংসদে উপস্থাপন করুক। কারণ আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই। জনগণের চিন্তার প্রতিফলন রাষ্ট্র পরিচালনায় ও দৈনন্দিন জীবনে ঘটাতে হবে।
খসরু বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। মানুষের চিন্তা–ভাবনা, দর্শন ও সৃজনশীলতা এখন উন্মুক্ত অবস্থায় আছে। সকলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সবাই নিজের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে। আমাদের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে এসবের কথা বলা আছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হতে পারলে আমরা যারা আন্দোলন করেছি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, যারা একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, জাতীয় সরকার গঠন করে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব। বিএনপি একা নয়, আমরা যারা সম্মিলিতভাবে ৩১ দফা প্রণয়ন করেছি, সবাই মিলে এটি বাস্তবায়ন করব।
তিনি বলেন, যে নতুন পথ তারেক রহমান দেখিয়েছেন, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্যের প্রতি সহনশীলতা ও সহানুভূতি দেখানো; অন্য মত হলেও সেটি গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। শুধুমাত্র সংস্কার করলেই হবে না, রাজনৈতিক সংস্কারের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। আমার বিরুদ্ধে কেউ বললেও তাকে সম্মান জানাতে হবে; তার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে। দ্বিমত পোষণ করব, কিন্তু সম্মান দিতে হবে।
খসরু বলেন, আপনারা দেখেছেন, তারেক রহমানকে একটি পত্রিকায় কার্টুনের মাধ্যমে সমালোচনা করা হয়েছিল। পরে তিনি (তারেক রহমান) বলেছেন, এটার জন্যই তো আমরা যুদ্ধ করেছি, এ স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য। এ স্বাধীনতা পাওয়ার জন্যই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। ভিন্ন বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আগের মতো দেশ পরিচালনা করা যাবে না। নতুন ভাবনায়, নতুন চিন্তায় আমরা যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি, সেই বাংলাদেশ হবে ভিন্ন বাংলাদেশ। অতীতের ভুল–ত্রুটি মুছে দিয়ে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি নতুন বাংলাদেশ গড়া হবে।
খসরু বলেন, বইমেলা জিনিসটা আমি ভুলে গিয়েছি। কারণ বিগত দিনে একটি দলের প্রতিষ্ঠাতা, তার মেয়ে, তার পরিবার ও তাদের চিন্তাভাবনা ও দর্শন প্রতিফলিত হতো বইমেলায়। এমনকি স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও তাদের পরিবারের দর্শন ও চিন্তাভাবনা কারিকুলামের মাধ্যমে পড়তে ও শিখতে বাধ্য করা হয়েছে। কোনো বিশেষ দর্শন, চিন্তা বা পরিবার যেন বাংলাদেশের মনোজগতে এককভাবে প্রবেশ করতে না পারে, সেটা আমরা আগামী দিনে নিশ্চিত করব। আমরা যদি আবার তাদের পথে চলি, তাহলে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন জিয়াউর রহমান সাহেব দেখে গিয়েছেন, সেই বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারব না।
তিনি বলেন, জাতীয়তাবাদী চিন্তার অনুসারীদের আগামী দিনে এই স্বাধীনতার চেতনাতেই বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। আমরা সংঘর্ষের রাজনীতি চাই না, প্রতিশোধের রাজনীতি চাই না। হ্যাঁ, বিচার অবশ্যই করতে হবে, যারা খুন করেছে, গুম করেছে, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। কাউকে বিচারের বাইরে রাখা যাবে না। একই সঙ্গে দেশ গঠনের প্রকল্পে বিএনপির যে চিন্তা রয়েছে, সেটি মাথায় রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
ডা. শাহাদাত হোসেনকে অভিনন্দন জানিয়ে আমীর খসরু বলেন, শাহাদাত নিরপেক্ষভাবে চট্টগ্রাম শহরকে সুন্দরভাবে গড়ার জন্য কাজ করুক। আপনারা তাকে সহযোগিতা করবেন। সমস্যা থাকবে, সে সব সমাধান দিতে পারবে না। আমরা দলীয়করণে বিশ্বাসী নই। সে সঠিকভাবে, নিরপেক্ষভাবে কাজ করুক, তাহলে বিএনপি লাভবান হবে। শেখ হাসিনার পথে হাঁটলে চলবে না।
ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, চসিক বাংলাদেশের একমাত্র সিটি কর্পোরেশন যেখানে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় ১০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমি মনে করি, এই বিপুল শিক্ষা কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাষার প্রসারে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। আমরা চাই সঠিকভাবে বাংলা অনুবাদ হোক। নগরীতে বিভিন্ন ইংরেজি সাইনবোর্ড ও দিকনির্দেশনামূলক চিহ্নের বাংলা অনুবাদ করতে এবং ভাষার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সিটি কর্পোরেশন সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
মেয়র নগরের সাইনবোর্ড ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ইংরেজি লেখাগুলোর সঠিক বাংলা অনুবাদ নিশ্চিত করতে একটি বিশেষ টিম গঠন করার ঘোষণা দিয়ে বলেন, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরামর্শে এই উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমি আসলে উনার কথার সূত্র ধরে এটাই বলছি যে, আমরা এ ধরনের একটা টিম তৈরি করতে চাই, সে টিম সাইনবোর্ডগুলোর অনুবাদ করবে।
মেয়র বলেন, আমাদের অনেক লেখক আছেন, কিন্তু অনেক সময় তারা তাদের লেখা ছাপাতে পারছেন না। আমরা চাই, লেখকরা সঠিক জায়গায় সুযোগ পান। আগামীতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এই সুযোগ করে দেবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সবসময় শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রাখতে আগ্রহী। এবারের অনুষ্ঠানে বাইরের কোনো শিল্পী গান করেননি, বরং নগরীর বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাই অংশগ্রহণ করেছেন।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে অনেক অগ্রসর। চসিকের মতো এতটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সারা বাংলাদেশের আর কোথাও গড়ে উঠেনি। সেজন্য আমি সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে চসিকের সকল কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে বাচ্চাদেরকে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিয়ে অন্ধকারে রেখেছিল। তাই দেশের প্রকৃত ইতিহাস লেখকদের লেখনীর মাধ্যমে তুলে আনতে হবে।
মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, বিগত সরকারের সময়ে বই–পুস্তক থেকে সত্য ইতিহাস তুলে দেওয়া হয়েছিল। শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। শুধু শেখ মুজিবের নাম গুণকীর্তন করা হয়েছে। তাই এখন সত্যিকারের ইতিহাস বই–পুস্তকে তুলে আনতে হবে। আজকে অন্তর্বর্তীকালিন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তাদের কাজ হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। আমরা দেখতে পাচ্ছি, নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। তাই বলতে চাই, সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত করা যাবে না। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে।
ব্যারিস্টার মীর হেলাল বলেন, চট্টগ্রামের এই বইমেলাতে সব ধরনের বই প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। যেটা গত ১৭ বছর ছিল না। তখন জাতীয়তাবাদী চেতনার কোনো প্রকাশকের বই ও কবিতা প্রকাশিত হতে দেওয়া হয়নি। সবসময় একটি বিশেষ দেশকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। এবারের বইমেলার আয়োজন দেখে অনেক স্বস্তি পেয়েছি। এখানে সব শ্রেণী–পেশার মানুষকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেজন্য সিটি কর্পোরেশনকে ধন্যবাদ জানাই।
এরশাদ উল্লাহ বলেন, জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে দেশ নতুন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। এমনই এক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ দিনটি বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্বে মিশে আছে এবং থাকবে চিরদিন।
চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি মো. সাহাব উদ্দীন হাসান বাবুর সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ আজিজ, অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার, এস এম সাইফুল আলম, হারুন জামান, ইয়াছিন চৌধুরী লিটন, আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জয়নাল আবেদীন জিয়া, আবুল হাশেম, ইস্কান্দর মির্জা, মো. সালাউদ্দিন, মো. কামরুল ইসলাম, মশিউল আলম স্বপন ও জাফর আহমেদ।
