কোনোমতেই থামানো যাচ্ছে না লঞ্চ দুর্ঘটনা

| রবিবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:০৩ পূর্বাহ্ণ

দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এক অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হল ঝালকাটির সুগন্ধা নদী; চলন্ত লঞ্চে পুড়ে অঙ্গার হল প্রায় অর্ধশত প্রাণ। নৌপথে আবারো মৃত্যুর মিছিল দেখলো বাংলাদেশ। একের পর এক ফেরিডুবিতে হতাহতের সংখ্যায় নতুন পরিসংখ্যান যোগ করলো ‘এমভি অভিযান-১০’ এর অগ্নিকাণ্ড।
খবরে প্রকাশ, ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকেই বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসার পর ইঞ্জিনে ‘সমস্যা হচ্ছিল’ বলেও জানিয়েছেন বেঁচে যাওয়া কয়েকজন যাত্রী। তবে লঞ্চ মালিকের দাবি, এ মাসেই লাগানো রিকন্ডিশনড ইঞ্জিনে কোনো ‘ত্রুটি ছিল না’। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইঞ্জিন রুমের কাছে রাখা কয়েক হাজার লিটার তেলের মাধ্যমে। লঞ্চে অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো ব্যবহারের ‘সময় পাওয়া যায়নি’। তাহলে কীভাবে আগুন লেগেছিল সেখানে? কীভাবে তা এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারল? ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে তদন্তের পর। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা সদরঘাট থেকে কয়েকশ যাত্রী নিয়ে রওনা হয়েছিল এমভি অভিযান-১০। চাঁদপুর, বরিশাল ও দপদপিয়া ঘাট পেরিয়ে লঞ্চটি যাচ্ছিল বেতাগী, শেষ গন্তব্য ছিল বরগুনা; শীতের রাতে যাত্রীদের অধিকাংশই ছিলেন ঘুমে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনোমতেই থামানো যাচ্ছে না লঞ্চ দুর্ঘটনা। শত শত প্রাণহানি ঘটলেও দুর্ঘটনা রোধে নেওয়া হয় না কোনো কার্যকর ব্যবস্থা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বার্ষিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ সময় প্রাণ যায় ৩ হাজারের অধিক মানুষের।
চলতি বছরের এপ্রিলে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিউটের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে দেশের নৌপথগুলোয় ৫৭৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৮২২ জন। আহত ৪১৯ এবং আজো সন্ধান মেলেনি ৮৬৪ জনের। অন্যদিকে, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সেভ দ্য রোড’ ২৪ ডিসেম্বর জানিয়েছে, কেবল ২০২১ সালেই নৌপথে দুর্ঘটনায় ১৮৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এই তথ্য গত ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অদক্ষ কর্মী এবং ফিটনেসহীন অবস্থার কারণেই নৌযান ডুবে যায়। অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও উচ্চ মৃত্যুর সংখ্যার আরেকটি কারণ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেকের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। তিনি জানান, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষ নৌযানের ক্রু সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়। সব ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
অথচ ২০২১ সালে প্রকাশিত বিআইডব্লিউটিসি’র একটি প্রতিবেদন বলছে, গত ১১ বছরে ৩৮৭ জাহাজ বা নৌযান ডুবি হয়েছে। তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগের অভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায়বিচার পায়নি। তবে চেয়ারম্যান সাদেকের মতে, নৌপথ কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকটি দুর্ঘটনার তদন্ত করে এবং আইনি ব্যবস্থা নেয়।
পত্রিকান্তরে আরো কয়েকজন বিশেষজ্ঞের অভিমত প্রকাশিত হয়। তাঁরা বলছেন, লঞ্চ ছাড়ার আগে ইঞ্জিন রুম, ফুয়েল কন্ট্রোল প্যানেল, নেভিগেশন সিস্টেমসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা হয় না অধিকাংশ লঞ্চে। তবে এই প্রথমবারের মতো যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন লাগলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে অতীতে যাত্রীবাহী কোনো লঞ্চ বা জাহাজে এমন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আর নেই। কখনো কখনো ডক ইয়ার্ডে মেরামতের সময়, যাত্রীবাহী লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষে বা কেবিন কক্ষে ‘ছোটোখাটো আগুনের’ ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি হয়নি। কিন্তু প্রাণহানির ভয়াবহতা ছাড়িয়ে যায় গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ আগুন লাগার ঘটনা।
লঞ্চে আপদকালীন সময়ে জীবন রক্ষার জন্য বেশকিছু সরঞ্জাম থাকার কথা। লঞ্চের ধারণক্ষমতা অনুসারে এসব সরঞ্জাম থাকার কথা। এর মধ্যে লাইফ-বয়া, লঞ্চের ছাদে ছোট বোট অন্যতম। তবে দেশের প্রতিটি লঞ্চই ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী বহন করে। সপ্তাহের শেষ দিন থাকায় বৃহস্পতিবার লঞ্চটিতে অনেক যাত্রী ছিল। ঘটনার সময় সবাই ছিল ঘুমে। এজন্য প্রাণহানি বেশি হয়েছে, লঞ্চটিও ছিল মাঝনদীতে। তাছাড়া লঞ্চটি চলতে থাকায় বাতাসে আগুন আরো ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে