চট্টগ্রামে দিন দিন বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। পাল্লা দিয়ে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপও। বিশেষ করে গত বেশ কিছুদিন ধরে হাসপাতালে রোগীর চাপ অতিরিক্ত বেড়েছে। মহানগরীতে করোনা চিকিৎসা দেয়া সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো এরইমধ্যে রোগীতে ভরে গেছে। শয্যা সংখ্যা বাড়িয়েও চাপ সামলাতে পারছে না বেসরকারি হাসপাতাল। তবে সবচেয়ে বেশি চাপ আইসিইউতে।
সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার একটিও খালি নেই। চিকিৎসাধীন কোনো রোগীর মৃত্যু না হলে আইসিইউ শয্যা খালি হচ্ছে না। দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটি শয্যা খালি হলেও চোখের পলকে তা ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। এতে করে শ্বাসকষ্টের ও অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়া জটিল রোগীরা বিপদে পড়েছেন।
বিশেষ করে মিনিটে যাদের ১৫ লিটারের বেশি অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন, এমন রোগীরা পড়েছেন জীবন সংকটে। কারণ, হাসপাতালগুলোর আইসোলেশন শয্যায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের মাধ্যমে মিনিটে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার করে অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। কিন্তু মিনিটে ১৫ লিটারের বেশি অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হলে সংশ্লিষ্ট রোগীকে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার মাধ্যমে উচ্চমাত্রায় অঙিজেন সাপোর্ট দিতে হয়। অথবা আইসিইউ এবং এইচডিওতে স্থানান্তর করতে হয়। আইসিইউ-এইচডিওতে রেখেও উচ্চমাত্রায় অঙিজেন সাপোর্ট দেয়ার সুযোগ রয়েছে।
তবে সব হাসপাতালে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। আর বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আইসিইউ-এইচডিও’র সব শয্যাই রোগীতে ঠাসা। একটি শয্যাও কোথাও খালি থাকছে না। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চমাত্রায় অঙিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন হলেও আইসিইউ/এইচডিও’র শয্যা মিলছে না। ফলে প্রয়োজনীয় মাত্রায় অঙিজেন সাপোর্ট না পাওয়া রোগীরা পড়েছেন জীবন সংকটে।
নির্মম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে মৃত্যু হচ্ছে অনেক রোগীর। কিন্তু হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংকট এবং আইসিইউ/এইচডিও’র শয্যা খালি না থাকায় নিরুপায় হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরাও। নগরীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দশটি আইসিইউ/এইচডিও শয্যা রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই এসব শয্যার একটিও খালি থাকছে না। একটি শয্যা খালি হয় বটে কিন্তু ৫ মিনিট না যেতেই আরেক রোগীকে সেখানে দিতে হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যায়ও আইসিইউ/এইচডিও’র কোনো শয্যা খালি ছিল না হাসপাতালের করোনা ইউনিটে। চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
১৬টি আইসিইউ শয্যায় রোগীর সেবা দেয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু এসব আইসিইউ শয্যার একটিও খালি থাকছে না বেশ কিছুদিন ধরে। এ তথ্য নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. আব্দুর রব মাসুম আজাদীকে বলেন, আমরা সর্বোচ্চ ১৬ জন জটিল রোগীকে আইসিইউতে সেবা দিতে পারি। তবে এমন আরো অনেক রোগী থাকেন, যাদের আইসিইউ সাপোর্ট ও উচ্চ মাত্রায় অঙিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন। কিন্তু আমরা নিরুপায়। আইসিইউতে শয্যা খালি না থাকলে আমাদেরও করার কিছু থাকে না।
২০টি আইসিইউ ও ১২টি এইচডিও শয্যা রয়েছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে। তবে অন্তত ২০ দিন ধরেই এসব আইসিইউ ও এইচডিও’র কোনো শয্যাই খালি থাকছে না। এ তথ্য নিশ্চিত করে হাসপাতালটির নির্বাহী কমিটির ট্রেজারার ও করোনা ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব রেজাউল করিম আজাদ বলেন, আমাদের আইসিইউ-এইচডিও যা আছে, সবকয়টি রোগীতে ভরা। এক মুহূর্তের জন্যও একটি শয্যা খালি থাকছে না। একটি আইসিইউ শয্যার জন্য প্রায় প্রতিদিনই ২০টির বেশি অনুরোধ থাকে। কিন্তু শয্যা খালি না থাকায় আমরা কিছু করতে পারছি না। আইসিইউ/এইচডিও’তে থাকা রোগী ছাড়াও প্রায় ৫০ জন রোগীকে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলায় উচ্চমাত্রায় অঙিজেন সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
একই চিত্র নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দশটি আইসিইউ শয্যায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে বেসরকারি ম্যাঙ হাসপাতালে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এর একটি শয্যাও খালি ছিল না। বিগত ১০/১৫ দিন ধরে আইসিইউর একটি শয্যাও খালি থাকছে না বলে জানান ম্যাঙ হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার রঞ্জন প্রসাদ দাশ। নির্ধারিত ৫৭টি কেবিনের সবকয়টিতে রোগী ভর্তি বলেও জানান তিনি।
দশটি আইসিইউ শয্যা থাকলেও ১২ জন রোগীকে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে। এ তথ্য নিশ্চিত করে পার্কভিউ হাসপাতালের এমডি ডা. এটিএম রেজাউল করিম বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে অবস্থা খুব খারাপ। আমাদের ৬০টি কেবিনের সবকয়টিতে রোগী ভর্তি। একটিও খালি নেই। জটিল রোগীদের জন্য দশটি আইসিইউ নির্ধারিত। অনেক দিন ধরে এর একটিও খালি থাকছে না। একটি আইসিইউ শয্যার জন্য প্রতিদিন অনেক ফোন আসছে। কিন্তু আমরা শয্যা দিতে পারছি না। বেশ কিছুদিন ধরেই এমন অবস্থা চলছে বলে জানান তিনি।
মেট্রোপলিটন হাসপাতালে আইসিইউ ও এইচডিও’র ১৫টি শয্যায় করোনা রোগীর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এর সবকয়টিতে রোগী ভর্তি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ সেলিম। নির্ধারিত ৫০টি কেবিনে ৫২ জন রোগী ভর্তি আছে জানিয়ে মোহাম্মদ সেলিম বলেন, আইসিইউ/এইচডিও’র পাশাপাশি বেশ কিছুদিন ধরে কেবিনও খালি থাকছে না। আইসিইউর জন্য প্রতিদিনই অনেক অনুরোধ আসছে। কিন্তু আমরা সিট দিতে পারছিনা।
বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালে ৮টি আইসিইউ শয্যায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। এসব আইসিইউর একটিও খালি ছিল না গতকাল রাতে। অন্তত ১০/১২ দিন ধরেই কোনো আইসিইউ শয্যা খালি থাকছে না বলে জানান ন্যাশনাল হাসপাতালের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন।
এবার গ্রামাঞ্চল থেকে করোনা রোগী বেশি আসছে জানিয়ে ডা. মো. আমজাদ হোসেন বলেন, করোনা রোগীদের জন্য কেবিন বাড়িয়ে আমরা ৫৯টি করেছি। এখন সবকয়টিতে রোগী ভর্তি। একটিও খালি নেই। সিএসসিআর হাসপাতালে চারটি আইসিইউ শয্যায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এই চার আইসিইউর একটি শয্যাও খালি নেই বলে জানান হাসপাতালটির আরএমও (আবাসিক চিকিৎসক) ডা. এমজাদ হোসেন।
করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত কেবিন/শয্যা বাড়িয়ে অন্তত দ্বিগুণ করেছে এসব বেসরকারি হাসপাতাল। এরপরও চাপ সামলাতে পারছে না হাসপাতালগুলো। আইসিইউর পাশাপাশি কেবিন/শয্যা খালি না থাকায় নতুন রোগী ভর্তি নিতেও হিমশিম খাচ্ছে এসব হাসপাতাল।
সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রতিদিন করোনায় শনাক্ত ও হাসপাতালে (নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক) ভর্তিকৃত রোগীর তথ্য সংক্রান্ত আপডেট দেয়া হয়ে থাকে। প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী- গত ২৪ মে চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৩৫৯ জন করোনা রোগী ভর্তি ছিল। ১০ জুন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দেখানো হয় ৪১৪ জন। ২৩ জুন দেখানো হয় ৪৯৮ জন। ৪ জুলাই ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৬৬ জনে।
সর্বশেষ ১৬ জুলাই হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৮৪ জনে। হিসেবে শেষ ১২ দিনে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়- চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ৬৫০ শয্যার বিপরীতে গত ১০ জুন ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা দেখানো হয় ২২৮ জন। ২০ জুন এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৯ জনে। ৪ জুলাই ৪২৪ জনে। আর সর্বশেষ গত ১৬ জুলাইয়ের হিসাব অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি রয়েছে ৭৭১ জন। হিসেবে ১২ দিনের ব্যবধানে রোগী বেড়ে দ্বিগুণ।
করোনার ভারতীয় ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) বিস্তার ঘটে যাওয়ায় সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। তিনি বলেন, ভাইরাসের ভারতীয় এ ধরন অন্যান্য ধরনের তুলনায় তিনগুণ বেশি সংক্রামক ও ভয়ানক বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ধরন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
মূলত ভারতীয় এ ধরনের কারণেই করোনার সংক্রমণ এখন ভয়াবহ পর্যায়ে। তবে শঙ্কার বিষয় যে, এবার গ্রামাঞ্চলেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা সুবিধা বলতে তেমন কিছু নেই। যার কারণে গ্রাম থেকে এসব রোগীকে শহরের হাসপাতালে আসতে হচ্ছে। সংক্রমণ থামানো না গেলে প্রথম ঢেউয়ের মতো কিংবা এর চেয়েও বেশি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ডা. সুশান্ত বড়ুয়া।
সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রোগীর চাপ তীব্র হচ্ছে জানিয়ে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, এর মধ্যে শ্বাসকষ্টের জটিল রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। অনেকের উচ্চমাত্রায় অঙিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন হচ্ছে। আমরা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বাড়িয়েছি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ইউনিট টু হিসেবে হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে রোগী ভর্তি শুরু করা হয়েছে। সেখানে ৬টি আইসিইউ প্রস্তুত করা হয়েছে। ২ জন রোগীকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
বিআইটিআইডি হাসপাতালেও ৫ শয্যার আইসিইউ চালু করা হয়েছে। এর মাঝে ৩ জন রোগীকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সুবিধা দ্বিগুণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু এরপরও আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সংক্রমণ বাড়তে থাকলে এবং রোগী আরো বাড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এ জন্য সকলের আরো বেশি সতর্ক হওয়া দরকার। নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে হলে মাস্ক পরার পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিধি অবশ্যই মানতে হবে।
সংক্রমণ ঠেকাতে দেশব্যাপী কঠোর বিধি-নিষেধ জারি করা হয়েছে। মানুষ যদি ঘরে থাকে, বিধি-নিষেধ মেনে চলে; তবে সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। অন্যথা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।