যান্ত্রিক ক্রটিতে প্রায় এক বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের ম্যামোগ্রাফি মেশিন। নারীর স্তনে টিউমার–ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয় অত্যাধুনিক এই যন্ত্র।
অকেজো থাকায় গত বছরের (২০২২ সালের) শুরু থেকে প্রায় বছর ধরে মেশিনটির সেবাও বন্ধ রয়েছে। এর আগে দীর্ঘ সাত মাস অচল থাকার পর ২০২১ সালের জুন মাসে মেশিনটি সচল হয়। কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই মেশিনটি ফের অচল হয়ে পড়ে। এরপর থেকেই মেশিনটির সেবা বন্ধ রয়েছে। মেমোগ্রাফি মেশিনের সেবা বন্ধ থাকার তথ্য নিশ্চিত করে হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুভাষ মজুমদার আজাদীকে বলেন, হঠাৎ করেই মেশিনটি বন্ধ হয়ে যায়। যান্ত্রিক ক্রুটির কারণেই এমনটি হতে পারে।
তবে কি সমস্যা সেটি আমরা ধরতে পারিনি। মেশিন অচল হওয়ার বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি। এর আগে পরীক্ষার অপরিহার্য উপকরণ ফিল্ম (নেগেটিভ) সংকটেও ২০২০ সালে প্রায় ৮ মাস অচল ছিল মেশিনটি। তবে প্রায় ৮ মাস পর মেশিনটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে একশ ফিল্ম যোগাড় করতে সক্ষম হয় হাসপাতাল প্রশাসন। ওই বছরের (২০২০ সালের) ৩১ অক্টোবর একশ ফিল্ম বুঝে পায় হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগ। কিন্তু ফিল্ম যোগাড় হলেও কোটি টাকার মেশিনটি ঘিরে জটিলতা রয়েই যায়। ফিল্ম যোগাড়ের পর চালু করতে গেলে যান্ত্রিক ক্রটি দেখা দেয় মেশিনটিতে। মাসের পর মাস অকেজো পড়ে থাকা এ মেশিন নিয়ে ২০২১ সালের ২৯ মে দৈনিক আজাদীতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘৩৩ মাসে ৩১ মাসই অচল সেই ম্যামোগ্রাফি মেশিন/অকেজোতেই শেষ হচ্ছে ওয়ারেন্টি সময়সীমা’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরই মেশিনটি সার্ভিসিংয়ের (সচলকরণে) কাজ শুরু করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিউটেক জিটি লিমিটেড’র লোকজন। টানা তিন কর্মদিবসের চেষ্টায় জুনের প্রথম সপ্তাহে মেশিনটি সচল করতে সক্ষম হয় তারা। এতে করে প্রায় ১৫ মাস পর অবশেষে কোটি টাকার মেশিনটি সচল হয়।
সচলের পর বেশ কয়মাস মেশিনটির সেবা চালু থাকে। তবে কয়েক মাস না যেতেই ফের অচল হয়ে পড়ে মেশিনটি। অকেজো থাকায় ২০২২ সালের শুরু থেকেই মেশিনটির সেবা বন্ধ রয়েছে। রেডিওলজির বিভাগের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়– যান্ত্রিক ক্রুটির কারণে এখন প্রায় বছর ধরে অকেজো রয়েছে এই ম্যামোগ্রাম মেশিন। এর আগে ফিল্ম সংকট ও যান্ত্রিক ক্রটির কারণে টানা ১৫ মাস ধরে অকেজো ছিল। এর আগেও মেশিনটি যান্ত্রিক ক্রটিসহ নানা জটিলতায় দফায় দফায় অকেজো হয়ে পড়ে ছিল। রেডিওলজি বিভাগ সূত্রে জানা যায়– ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এ মেশিনের সেবা চালু করা হয়। তবে উদ্বোধনের পর থেকে সাড়ে চার বছরে মেশিনটি সবমিলিয়ে একবছরও সচল থাকেনি। কয়দিন যেতে না যেতেই অকেজো হয়ে পড়ে। হিসেবে দেখা যায়– সেবা চালুর ৫৪ মাসের মধ্যে প্রায় ৪৫/৪৬ মাসই অচল ছিল কোটি টাকার এ মেশিন! কোটি টাকার এ মেশিনের দিনের পর দিন অকেজো থাকার কারণ হিসেবে এর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতাকেই দুষেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতাল প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের দাবি– মেশিনটি স্থাপন থেকে শুরু করে ফিল্ম সংকট এবং ফিল্ম যোগাড় পরবর্তী মেশিন চালু করতে না পারাসহ সার্বিকভাবে মেশিনটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটির অদক্ষতার কারণেই মেশিনটির সেবা চালু করতেও বিলম্ব হয়। পরে ফিল্ম সংকটেও ভুগতে হয়। দফায় দফায় যোগাযোগ করেও তাদের কাছে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। অদক্ষতার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে হাসপাতাল প্রশাসন। জানতে চাইলে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান গতকাল আজাদীকে বলেন, মেশিনটির অচল হওয়ার বিষয়টি জেনে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে এ পর্যন্ত দফায় দফায় চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে কথা বলবেন বলেও জানান হাসপাতাল পরিচালক।
হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের তথ্য মতে– রেডিওলজি বিভাগে সিঙ্গল (একটি) স্তনের ম্যামোগ্রাফ টেস্টে ৪০০ টাকা এবং ডাবল (দুটি) স্তনের টেস্টে ফি ৮০০ টাকার বেশি নয়। কিন্তু প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে এই টেস্ট ফি সিঙ্গল টেস্টে দেড় হাজার এবং ডাবল স্তন টেস্টে তিন হাজার টাকার কম নয়।
উল্ল্লেখ্য, নারীর স্তনে টিউমার–ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয় অত্যাধুনিক এ মেমোগ্রাফি মেশিন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্তন পরীক্ষায় এমন অত্যাধুনিক যন্ত্র পায়নি চমেক হাসপাতাল। তবে ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য একটি করে মেশিন বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইতালি থেকে আমদানি করা দুটি মেশিনের খরচ পড়ে ৩ লাখ ৮১ হাজার ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা তিন কোটি ৩২ লাখ ৩ হাজার ৯২১ টাকা। হিসেবে প্রতিটির মূল্য ১ কোটি ১৬ লাখ টাকারও বেশি। কিন্তু কোটি টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক এ যন্ত্র চমেক হাসপাতালে বাঙবন্দি ছিল প্রায় বছর ধরে! হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের একটি ছোট্ট কক্ষে এমন অবস্থায় পড়ে ছিল মেশিনটি। পরবর্তীতে হাসপাতালে আনার প্রায় দেড় বছর পর (২০১৮ সালের) ৬ আগস্ট অবশেষে সেবা চালু হয় কোটি টাকা মূল্যের ম্যামোগ্রাফি মেশিনটির।