সৌখিনতার কারণে এলাকাবাসীর কাছে তিনি পরিচিত। পাঁচ লাখ টাকা দামের ইয়ামাহা আর ওয়ান ফাইভ মোটর সাইকেলে চড়েন। ব্যবহার করেন দুই লাখ ৩২ হাজার টাকা দামের হুয়াওয়ে ম্যাট এক্স এস এবং ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দামের আইফোন-১১ প্রো ম্যাক্স মোবাইল ফোন। তার পালিত দুটি বিদেশি কুকুরের জন্য দৈনিক মাংসের প্রয়োজন হয় পাঁচ কেজি। আত্মীয়-স্বজনের কাছে তিনি স্বর্ণ ও সিএনজি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। আবার যেখানে ভাড়া থাকেন সেই বালুছড়া এলাকার মানুষের কাছে তিনি পরিচিত কোটিপতি হিসেবে। এস আলমের সাথে ব্যবসা আছে তার।
বাস্তবে তার পেশা ও নেশা হলো চুরি। চুরি করে বেড়ান নগর জুড়ে। তার নাম জাহিদ প্রকাশ খালিদ হাসান প্রকাশ ইমন (৩৭)। গত ২৪ ঘণ্টায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সহযোগী আশরাফ, স্ত্রী ও প্রেমিকাসহ ইমনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৭ ভরি স্বর্ণ, মোবাইল ও নগদ অর্থ উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা হয় তার ব্যবহৃত মোটর সাইকেল দুটিও।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন আজাদীকে বলেন, ইমন এ পর্যন্ত ৪০০ চুরি করেছে। এর আগেও ধরা পড়েছেন চারবার। কিছুদিনের মধ্যে বেরিয়ে এসে ফিরে গেছেন পুরনো পেশায়। তিনি রাতে চুরি করেন না। দুপুরে বা সন্ধ্যায় বিভিন্ন বাসার তালা ঠিক রেখে শুধু কড়াটা কেটে কৌশলে ভেতরে ঢুকে দশ থেকে পনের মিনিটের মধ্যে চুরি করে বের হয়ে যান। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সমপ্রতি নগরীর নন্দন কানন হরিশদত্ত লেইন, আন্দরকিল্লা রাজাপুকুর লেইন ও হেম সেন লেইন এলাকার তিনটি বাসায় চুরি করেন ইমন ও তার সহযোগী আশরাফ। গত ৫ মার্চ রাত সাড়ে ৯টায় হেম সেন লেইন বড়ুয়া গলির বসুন্ধরা ভবনের দ্বিতীয় তলার গৃহকর্তা বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে সেই ফাঁকে ঘরে ঢুকে ১৭ ভরি স্বর্ণ, ৩০০ প্রাইজবন্ড ও ১ লাখ ৫ হাজার টাকা চুরি করেন।
চলতি মাসের ১৬ তারিখ একই দিনে নন্দন কানন ও রাজাপুকুর লেইনে দুটি বাসায় নগদ ২ লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার চুরি করেন ইমন। নড়ে চড়ে বসে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। তদন্তে নেমে দেখতে পায় ঘটনাগুলোর মধ্যে কোথাও মিল রয়েছে। আসে সিসিটিভি ফুটেজ। সেখানে দেখা যায়, ঘটনার আগে নির্দিষ্ট ভবনে মাস্ক পরিহিত এক যুবক প্রবেশ করে। হাতে চিপস, চানাচুর কিংবা বিস্কুটের প্যাকেট। অন্য হাতে গ্রিল কাটার জাতীয় ছোট সাইজের কিছু একটা রয়েছে। ফাঁদ পাতে পুলিশ। সেই ফাঁদে অবশেষে ধরা দেন ইমন। পরে তার বাসা তল্লাশি করে দেখা যায় এলাহি কারবার।
অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তা এএসআই অনুপ বিশ্বাস আজাদীকে বলেন, সবকিছু বাদ দেন। তার জুতোর র্যাকটা ছাদের কাছাকাছি উঁচু। যেন জুতার শো-রুমের গ্যালারি। একেক জোড়া জুতার দাম পনের থেকে বিশ হাজার টাকা।
গ্রেপ্তারের পর গতকাল কোতোয়ালী থানায় ইমন আজাদীকে জানান, পিরোজপুরে তার জন্ম। বাবা খলিলুর রহমান কৃষিকাজ করতেন, আবার ছোটখাটো অপরাধেও জড়িত ছিলেন। মা ছিলেন গার্মেন্টসকর্মী। তাদের একমাত্র সন্তান তিনি। মা গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে বিদেশ যাওয়ার ফাঁকে তার বাবা আরেকজনকে বিয়ে করে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। এসএসসি পাস করার পর তিনি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় বাবার কাছে আসেন। কিন্তু সৎ মায়ের অত্যাচারে এক মাসের বেশি টিকতে পারেননি। ২০০৪ সালের দিকে একদিন রাগ করে চলে আসেন চট্টগ্রামে। রেলস্টেশনে রাত কাটে। পরদিন হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছান জাকির হোসেন রোডে। সেখানে এক চায়ের দোকানে চাকরি নেন। তাও টিকেনি। গ্লাস ভাঙার অপরাধে মালিক তার মুখে চা ছুড়ে মারে। সেদিনই চাকরি ছেড়ে চলে আসেন পুরাতন রেলস্টেশনের গ্রামীণ মাঠে।
ইমন বলেন, গ্রামীণ মাঠে বসে গাঁজা খাচ্ছিলাম। এ সময় অহিদ নামে একজনের সাথে আলাপ হয়। সে এ লাইনে আমার বস। সব শুনে আমাকে নিয়ে পতেঙ্গা এলাকায় একটি বাসায় নিয়ে যায়। আমাকে রেখে উপর তলায় ওঠে। কিছুক্ষণ পর আসে। দেখি হাতে দুটি মোবাইল ও ৭/৮ হাজার টাকা। আমাকে দুই হাজার টাকা দিয়ে আবার স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে যায়। বলে হোটেলে থাকতে। এরপর থেকে অহিদের সাথে বিভিন্ন কাজে যেতাম। ২০০৭ সালের দিকে কর্ণফুলী থানা এলাকায় একটা বড় চুরি করেন। স্বর্ণ, টাকা মিলে পরিমাণটা ছিল ৪২ হাজার টাকা। কিন্তু তাকে দেয় মাত্র ১৭০০ টাকা। সে ভাবে, মামলা হলে যদি একই শাস্তি ভোগ করতে হয়, তবে একা কাজ করলে ক্ষতি কী? শুরু হয় তার একাকি পথ চলা।
কোতোয়ালী থানার এসআই মোমিনুল আজাদীকে বলেন, ২০০৮ সালে ইমন বন্দর থানায়, ২০১৫ সালে হালিশহর থানায়, ২০১৬ সালে সদরঘাট থানায় এবং ২০২০ সালে ধরা পড়ে বাকলিয়া থানা পুলিশের হাতে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একবার চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনি খেয়ে হাসপাতালে ছিল প্রায় এক মাস। এরপর তিন মাস কাজ বন্ধ রাখে। আবার শুরু হয়।
ইমন জানান, কোনো ভবনে ওঠার সময় হাতে শুকনো খাবারের প্যাকেট রাখেন, যাতে কেউ জানতে চাইলে বলতে পারেন, অমুক বাসায় বেড়াতে এসেছি। তালা ভাঙার চেষ্টা করেন না। তালাটা যে কড়ায় আটকে রাখে সেটি কাটার দিয়ে কাটেন। ঘরের ভেতর সর্বোচ্চ দশ থেকে পনের মিনিট থাকেন। এর মধ্যে মোবাইল, ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা চুরি করে বেরিয়ে যান। তবে গত কিছুদিন ধরে মোবাইল আর ল্যাপটপ চুরি করেন না। কারণ তাতে প্রশাসন দ্রুত শনাক্ত করতে পারে।
তার বাসার বিবরণ দিতে গিয়ে পুলিশ জানায়, দুটা আলাস্কান মেলামিউট প্রজাতির কুকুর রয়েছে। বিদেশি বিড়ালও আছে ৭/৮টা। কুকুর দুটির জন্য প্রতিদিন পাঁচ কেজি মুরগির মাংসের প্রয়োজন হয়। তার ইয়ামাহা আর ওয়ান ফাইভ মোটর সাইকেল ছাড়াও টিভিএস মোটর সাইকেল রয়েছে আরেকটি। তার সংগ্রহে আছে বিশ্বের নামীদামি ব্র্যান্ডের প্রায় আড়াইশ পোশাক। টাকা চুরি করলে কখনো বাসায় নিয়ে যান না। যে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে সেই ব্যাংকের এক অফিসারকে অ্যাকাউন্ট নম্বরটা দিয়ে টাকাগুলো জমা দিতে বলেন। তবে স্বর্ণ বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট দোকান আছে। পুলিশকে ইমন জানিয়েছে, তার অ্যাকাউন্টে দশ লাখ টাকা আছে। তবে পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করেনি।
ইমন প্রথম বিয়ে করেন ২০১০ সালে। তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সেই ঘরে ১২ বছরের একটি সন্তান আছে। ২০১২ সালে রামু থেকে করেন দ্বিতীয় বিয়ে। তার সাথেও সংসার টিকেনি। ২০১৬ সালের দিকে রামু থেকে করেন তৃতীয় বিয়ে। গত তিন মাস ধরে আপন শালীর সাথে চলছে প্রেমের সম্পর্ক। ইমন জানান, স্যার জীবনে অনেক কষ্ট পাইছি। অনেক দাগা খাইছি। এজন্য বাকি জীবনটা ‘এনজয়’ করে কাটিয়ে দেব। যা-ই করি এনজয় করি।