বিজ্ঞানের তত্ত্বগত ব্যাখ্যা ও সামাজিক বিধি ব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। বিজ্ঞান যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। তাছাড়া প্রমাণ ব্যতীত বিজ্ঞান কোন তত্ত্বকে গ্রহণ করে না। একজন বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন যাবত গবেষণা করে একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। কিন্তু পৃথিবীর সবাই সেই তত্ত্ব গ্রহণ করবে যদি তিনি তা প্রমাণ করতে পারেন। পূর্বে মানুষ মনে করতো সূর্য পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘুরে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন যে, সূর্য পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘুরে না। বরং পৃথিবীর সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরে। বিজ্ঞানীরা এটা প্রমাণ করার পর মানুষ বিশ্বাস করতে লাগলো যে, পৃথিবীর সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরে। কিন্তু সামাজিক বিষয়গুলোকে সেভাবে প্রমাণ করা যায় না। অধিকাংশ সামাজিক বিষয় সমাজে বসবাসরত মানুষের আচার আচরণ, রীতিনীতি ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। আবার মানুষের আচরণ, রীতিনীতি ইত্যাদি নির্ভর করে অঞ্চল, প্রাকৃতিক পরিবেশ, আবহাওয়া, জলবায়ু, খাদ্যাভ্যাস এবং ধর্মীয় রীতিনীতির ওপর। যেমন– পৃথিবীর মধ্যে যেসব অঞ্চল তুলনামূলক শীতল, ঐসব অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের মধ্যে কম উগ্রতা পরিলক্ষিত হয়। তারা কারণে অকারণে হঠাৎ করে রেগে যায় না। কিন্তু উষ্ণ অঞ্চলে বসবাসরত মানুষগুলোর মধ্যে একটু বেশি রাগান্বিত ভাব পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া জীবনযাত্রা নির্বাহের ধরনের মধ্যেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন– এশিয়া অঞ্চলে অবস্থিত দার্জিলিং হচ্ছে এমন একটি অঞ্চল যে অঞ্চলে প্রায় বার মাসই ঠান্ডা আবহাওয়া পরিলক্ষিত হয়। এ অঞ্চলে বসবাসরত মানুষেরা বৎসরের বার মাসই গরম জামাকাপড় পরিধান করে। এজন্য দার্জিলিং এ যদি আপনি ভ্রমণ করতে যান তবে দেখতে পাবেন, কোন হোটেলে বা গাড়ীতে কোন এসি নেই। দার্জিলিং এর সব ধরনের হোটেলে কোন ফ্যান বা এসি নেই। আছে হিটার। আমরা যে কোন ভ্রমণে একটু আরামে যাওয়ার জন্য এসি গাড়ী পছন্দ করি। কিন্তু দার্জিলিং এর তা নয়। এখানকার মানুষেরা গাড়ীতে উঠে হিটার চালায়। এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সারা বছর গরম কাপড় পরিধান করতে দেখা যায়। দার্জিলিং এর সমাজ ব্যবস্থা এভাবে গড়ে উঠেছে। কাজেই পরিবেশ, সামাজিক রীতিনীতি, আবহাওয়া ইত্যাদির প্রভাব মানুষেরা মধ্যে থেকে যায়।
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার মধ্যে ইদানীং পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এ পরিবর্তন এখনও চলমান। বর্তমান উপদেষ্টাদের মধ্যে অনেকে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে এমন কোন অফিস নেই যেখানে ঘুষ ছাড়া কাজ হয়, দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশে ঘুষ নেয়াটা এক ধরনের ন্যায্যতায় পরিণত হয়েছে। এটা যেন অফিস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অধিকারে পরিণত হয়েছে। সমাজের একজন নাগরিক হিসেবে আপনি যে কোন কাজ করতে যান দেখা যাবে অপ্রত্যক্ষ চাঁদাবাজি সেখানে রয়েছে। সমাজের এ ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য এবং সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিটি মানুষের ন্যায্য অধিকার যথাযথভাবে নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছেন উপদেষ্টামণ্ডলী। যেদিন এদেশের মানুষ এবং সরকারি কর্মকর্তারা সভায় মনে করবে দেশটি আমাদের এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে কাজ করা আমাদের দায়িত্ব। সেইদিন বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ। অন্যথায় ক্ষমতার হাত বদল হবে মাত্র। যেই তিমির সেই তিমিরেই থেকে যাবে বাংলাদেশ।
শিক্ষাক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক বিশাল প্রভাব পড়তে পারে। অতি প্রাচীনকাল থেকে দেখা যেত গভীর গণ্ড গ্রামে অবস্থিত স্কুলটির সেই শিক্ষকেরা গ্রামের সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন ভূমিকা রাখতো। তারা গ্রামের অশিক্ষিত, দরিদ্র শ্রেণিকে অতি, অল্প বয়সে নিজ কন্যাদ্বয়দের বিয়ে না দেয়ার জন্য পরামর্শ দিত। ঋণ করে যাতে বিলাসী জীবন যাপন না করে সে বিষয়ে বুঝাত। তাছাড়া ছোটখাট পারিবারিক বিষয়ে গ্রামের মুরুব্বিদের কিছু ধারণা দিত যা গ্রামের সমাজ ব্যবস্থাকে শান্ত রাখত। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর সর্বক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ, প্রভূতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের যেভাবে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তা কোনো অবস্থাতেই কাম্য ছিল না। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষককেও যদি অপমান করা হয় তবে উক্ত প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য শিক্ষক কিভাবে আগের ন্যায় স্বতস্ফূর্ত ক্লাশ নেবেন? হ্যাঁ, নেবেন। ক্লাশ নেয়ার জন্য নেবেন। কারণ তাকে বেতন নিয়ে সংসার চালাতে হবে। কিন্তু হৃদয় দিয়ে কখনো ক্লাশ নেবেন না। আর যে শিক্ষকটিকে বেঁধে রেখে অপমানিত করা হলো তিনি তো কখনো ক্লাশে ফিরে যাবেন না। বরং মৃত্যুই তার কাছে শ্রেয়। আর যে শিক্ষকটিকে জুতার মালা দিয়ে ঘুরিয়েছেন তিনিতো আর শিক্ষক রইলো না। তিনি তো সেই দিনই মারা গেছেন। তবে শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয় এ বলে সান্ত্বনা দিয়েছেন যে– এসব অন্যায়ের বিচার হবে। কেননা তিনিও এক সময়ে শিক্ষক ছিলেন।
এই যে ঘটনাগুলো ঘটে গেলো এবং কেউ এর প্রতিবাদ করলো না, তা থেকে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার এক বিশাল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সেই পরিবর্তনটা হবে এরূপ– শ্রেণিকক্ষে ছাত্ররা শিক্ষককে সমীহ করবে না, ছাত্ররা (অধিকাংশ) ক্লাশে মনযোগী হবে না। শিক্ষকেরাও মানসম্মত পাঠদানে আগ্রহী হবে না। ফলে আগামী ২০ বছরেরর মধ্যে জাতি হয়ে উঠবে মেধাহীন। সমাজ হয়ে পড়বে অশান্ত। সমাজের শান্তি দূরীভূত হবে। পরস্পর হিংসাবিদ্বেষ, হানাহানি বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। আর শিক্ষকতা পেশা হবে নির্জীব। এ পেশায় আর কোন মেধাবী এমন কি স্বল্প মেধাবী ছাত্রও আসতে চাইবে না। যদিও বেকারত্বের ভীড়ে কিছু স্বল্প মেধাবী ছাত্র শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেবে তবুও সুযোগ পেলে তারা আর শিক্ষকতা পেশায় থাকবে না। এইতো গেল শিক্ষকদের কথা। এবার আসা যাক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কথা। এটা খুবই স্বাভাবিক যে কোন পট পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরও পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে তা হচ্ছে। এতে অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু পরিবর্তিত প্রতিষ্ঠান প্রধানদের মনে রাখতে হবে, পূর্বে যেভাবে প্রতিষ্ঠান চলেছিল সেভাবে নয়, প্রতিষ্ঠান প্রধান আরো স্বচ্ছভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। প্রতিষ্ঠান থেকে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পরিহার করতে হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে এমন কৌশল অবলম্বন করতে হবে যাতে ঘুষ ও দুর্নীতি করার সুযোগ কেউ না পায়। তবেই সমাজ হয়ে উঠবে স্বচ্ছ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে পরবর্তীতে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার আর একটি পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এদেশে গ্রাম–গঞ্জে, পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ইসলামী চিন্তাবিদ, সাধক এবং ফকিরের মাজার। এক সময়ে এদেশে ইসলাম প্রচারে এই সব সাধকদের ভূমিকা ছিল বেশি। সময়ের পরিক্রমায় এসব সাধক, ধর্ম প্রচারকদের মৃত্যুর পরে গড়ে উঠেছে মাজার। এদেশের প্রতিটি মাজারের ভক্ত মানুষের সংখ্যা অধিক। আবার এসব মাজারের আশে পাশে গড়ে উঠেছে অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপ। এগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। হঠাৎ করে যদি মাজার ভাঙ্গা হয় তবে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে। মাজার ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে নতুন এক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পূর্বে অর্থাৎ পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য এত বেশি ছিল যে, স্বয়ং সরকারের প্রতিনিধিরা চাঁদা দাবি করতো। আমি সমাজের কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি নই। যেহেতু ৩৬ বছর শিক্ষকতা করেছি সেহেতু মনের মধ্যে একটা বিশ্বাস ছিল যে, আমার সামনে কেউ চাঁদা দাবি করবে না। অথচ আমার এলাকার এ জনপ্রতিনিধি নীরবে চাঁদাবাজি করে গেছে বা এখনো লোকেমুখে শোনা যায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে আশা করা যায় এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে। যদি পরিবর্তন হয় তবে সমাজ এগিয়ে যাবে। আর যদি পরিবর্তন না হয় তবে বলা যাবে নতুন পুরাতন পানীয় সরবরাহ করা হয়েছে। আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় আর একটি বিষয় পরিবর্তনের ব্যাপক ঝুঁকিতে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যখন সরকার পরিবর্তন হতো তখন এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সকল দোষ চাপিয়ে দিয়ে কিছু লোক তাদের ঘরবাড়ী, মন্দির জ্বালিয়ে দিত। কিন্তু নির্বাচনবিহীন কোন সরকারের পতন ঘটলে তাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কোনো দোষ চাপানো হতো না। ফলে তাদের ঘর–বাড়ি, মন্দিরের কোনো ক্ষতি হতো না। এ বারই প্রথম– সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে যা কখনো কাম্য নয়। বিশেষ করে প্রতিবেশি সুলভ যে আচরণ তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে ব্যাপক। পরস্পরের মধ্যে সন্দেহের অবকাশ থেকে যাবে। অবশ্য এটাও দেখা গেছে যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির পাহারা দেয়ার ব্যবস্থাও করেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। তবে সিনিয়র সিটিজেনদের অপমান করার মত অবস্থা ভবিষ্যতে না ঘটুক– ইহাই সবার কাম্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি, চট্টগ্রাম