ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে অসংখ্য নাইজেরিয়ানের পা পড়েছে। এদের একজন জ্যাকব ফ্রাঙ্ক। তিনি দীর্ঘ ৯ বছর ছিলেন এ দেশে। হয়েছিলেন নাইজেরিয়ান কমিউনিটির প্রেসিডেন্টও। বাংলাদেশকে কোকেন পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারকারী চক্রের গডফাদার সেই জ্যাকব ফ্রাঙ্কই। গত বছর চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে প্রায় চার কেজি কোকেন জব্দের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আদালতে দেওয়া চার্জশিটে উঠে এসেছে জ্যাকব ফ্রাঙ্কের বিষয়টি। তিনি ডন ফ্রাঙ্কি এবং জন লেরি নামেও পরিচিত। নাইজেরিয়ার এনগু প্রদেশে তার বাড়ি। গত মাসের ১৩ আগস্ট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক লোকাশীষ চাকমার দাখিলকৃত চার্জশিটে আরো তিনজন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন, আফিজ ওয়াহাব, ইকেচুকু এনওয়াগউ ও স্টিলা সান্তাই। এর মধ্যে স্টিলা সান্তাই বাহামা দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দা। বাকী দুজন জ্যাকব ফ্রাঙ্কের দেশ নাইজেরিয়াতেই। তারা দুজন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলতেন। থাকতেন ঢাকার খিলক্ষেতের নামাপাড়ার একটি বাসায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ–পরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার দৈনিক আজাদীকে বলেন, জ্যাকব ফ্রাঙ্ক দুই বছর আগে নাইজেরিয়াতে চলে যান। সেখানে বসেই তিনি স্টিলা সান্তাই’র মাধ্যমে ব্রাজিল থেকে চট্টগ্রামে প্রায় চার কেজি ওজনের কোকেন চোরাচালানের পরিকল্পনা করেন। তিনি আরো পরিকল্পনা করেছিলেন যে, চট্টগ্রাম থেকে উক্ত কোকেন ভারত হয়ে অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপের কোন দেশে পাচার করবেন। মাদকদ্রব্য নিযন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, ব্রাজিল থেকে অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপে কোকেন চোরাচালান সহজ বিষয় না। সেখানে অনেক চেকিং থাকে। যার কারণে বাংলাদেশকে কোকেন পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন জ্যাকব ফ্রাঙ্ক। তিনি আরো বলেন, বিমানবন্দরে কোকেন জব্দের ঘটনায় তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছিল। এরমধ্যে জ্যাকব ফ্রাঙ্কের নাম ছিল না। তদন্তেই তার নামটি উঠে এসেছে। বাংলাদেশকে কোকেন পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারকারী চক্রের গডফাদার জ্যাকব ফ্রাঙ্ক বলেও জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
আদালতসূত্র জানায়, কোকেন জব্দের মামলার চার্জশিটভুক্ত চারজন আসামির মধ্যে জ্যাকব ফ্রাঙ্ক ছাড়া অন্য তিনজন চট্টগ্রামে কারাগারে রয়েছেন। জ্যাকব ফ্রাঙ্ক পলাতক। গত বছরের ১৫ জুলাই চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় চার কেজি কোকেনসহ বাহামা দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দা স্টিলা সান্তাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার সাথে থাকা লাগেজ ট্যাগ, বোর্ডিংকার্ড, পাসপোর্ট এবং একটি মোবাইল ফোনও জব্দ করা হয়। তার লাগেজ স্ক্যানিং করার সময় মাদকের নমুনা শনাক্ত হয়নি। লাগেজ খোলা হলে দেখা যায়, লাগেজের মধ্যে একটি আইপিএস। সেই আইপিএসের মধ্যে একটি কার্টন, যার ভেতরে সাতটি পলিব্যাগ। প্রতি ব্যাগে ৫শ থেকে ৬শ গ্রাম করে সাদা বর্ণের কোকেনসদৃশ বস্তু ধরা পড়ে। পরে রাসায়নিক পরীক্ষা করলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে সেগুলো কোকেন। এ ঘটনায় পরদিন ১৬ জুলাই পতেঙ্গা থানায় স্টিলা সান্তাই, আফিজ ওয়াহাব ও ইকেচুকু এনওয়াগউ’কে আসামি করা হয়। কিন্তু অধরা ছিল আফিজ ও ইকেচুকু। পরবর্তীতে একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে এ দুজনকেও গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে তখন জানানো হয়েছিল যে, কোকেন চোরাচালানে চট্টগ্রামকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে পাঠানো হচ্ছিল ভিন্ন দেশে। নাইজেরিয়ার একটি চক্র এই কোকেন পাচারের সাথে জড়িত। কোকেনের উৎস দেশ ছিল ব্রাজিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ঢাকার বদলে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। বাহামা দ্বীপপুঞ্জের নাগরিক স্টিলা সান্তাই পেশায় একজন সেলসম্যান। আদালতে দেওয়া চার্জশিটে বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদে স্টিলা জানায়, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। এ জন্য তার টাকার প্রয়োজন ছিল। বিষয়টি তিনি তার চাচাতো ভাই ডিওন’কে জানান। এরই ধারাবাহিকতায় তার চাচাতো ভাই তাকে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করে দিবেন বলে জানান এবং জ্যাকব ফ্রাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। জ্যাকব ফ্রাঙ্ক তাকে ব্রাজিলের সাও পাওলোতে এসে কিছু কাগজে সই করার জন্য বলেন। সেখানে বিমানযোগে পৌঁছানোর পর জ্যাকব ফ্রাঙ্ক তাকে জানান, একটি উপহারের ব্যাগ বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিতে হবে। স্টিলা এতে রাজি হলে এক ব্যক্তি তাকে লাগেজটি হস্তান্তর করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে এমিরেটাস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে স্টিলা গত বছরের ১৩ জুলাই সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামে আসেন এবং চার দিনের অন–অ্যারাইভাল ভিসা নেন। চার্জশিটে বলা হয়, চট্টগ্রামে আসার জ্যাকব ফ্রাঙ্কের নির্দেশনা অনুযায়ী নগরীর হোটেল আগ্রাবাদে মুসাফির ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মাধ্যমে স্টিলার থাকার ব্যবস্থা হয়। বলা হয়, শাহ আমানত বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর স্টিলা লাগেজটি হারিয়ে ফেলেন এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানান। পরে ১৫ জুলাই লাগেজটি খুঁজে পাওয়া গেলে স্টিলা তা নিতে যান। উক্ত সময়ে বিমানবন্দরে থাকা নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সন্দেহবশত তার লাগেজটি স্ক্যান করে কোকেনের আলামত দেখতে পান। চার্জশিটে আরো বলা হয়, প্রায় চার কেজি ওজনের কোকেন জব্দের ঘটনায় আরো কয়েকজনের নাম এসেছে। তবে তাদের সঠিক পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় চার্জশিট তাদের অন্তভুক্ত করা হয় নি। পরে যদি তাদের নাম–পরিচয় সঠিক পাওয়া যায় তাহলে সম্পূরক চার্জশিট জমা দেওয়া হবে। চট্টগ্রামের হোটেল আগ্রাবাদে চালানটি পৌঁছে দিলে স্টিলাকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়ার কথা ছিল বলেও জিজ্ঞাসাবাদে স্টিলা তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান। চার্জশিটে আফিজ ওয়াহাব সম্পর্কে বলা হয়, আফিজ ওয়াহাব এক বাংলাদেশি নারীকে বিয়ে করেছেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি ফেনী ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলেন। তার ভিসা ২০১২–২০১৩ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। এর আগেও তিনি একই কারণে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ইকেচুকু ফুটবল খেলতেন বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে। তার ভিসাও মেয়াদোত্তীর্ণ। আদালতসূত্র জানায়, বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার পরবর্তী স্টিলা সান্তাই চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।










