নির্মম বাস্তবতা; ট্রাকচাপায় মা-বাবা ও বোনকে হারিয়ে অলৌকিকভাবে জন্ম নেওয়া শিশুটি বর্তমানে ময়মনসিংহ নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শিশুটি সুস্থ আছে। শোকের মাতম থামছে না নবজাতকের স্বজনদের। বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, অতীতেও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ওই পরিবারের ৫ জন সদস্য।
স্বজনরা জানান, শনিবার বিকেলে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন চিকিৎসকের কাছে। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিল ৬ বছরের শিশুকন্যা সানজিদা। পরিকল্পনা মতো ত্রিশালের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে ফিরছিলেন বাড়ির পথে। কিন্তু মহাসড়ক পার হওয়ার সময় বেপরোয়া একটি মালবাহী ট্রাক চাপা দিলে ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় মা-বাবার। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয় বোনের। তবে দুর্ঘটনার সময় মায়ের পেটের উপর দিয়ে মালবাহী ট্রাকের চাকা চলে গেলেও অলৌকিকভাবে ভূমিষ্ট হয় ফুটফুটে এক নবজাতক।
ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক নারী শিশুটিকে কাপড়ে মুড়ে প্রাথমিক যত্ন দিতে সহায়তা করেন। তাকে প্রথমে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পর বোঝা যায় নবজাতক আহত হয়েছে। বর্তমানে শিশুটি ময়মনসিংহের লাবীব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে জানিয়ে ওই হাসপাতালের পরিচালক মো. শাহজাহান জানান, জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন ও ত্রিশালের একজন ব্যবসায়ী নিয়মিত শিশুটির খোঁজখবর রাখছেন। বর্তমানে শিশুটি সুস্থ আছে।
হাসপাতালটির শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুজ্জামান জানান, নবজাতক শিশুটির হাতের কনুইয়ের উপরে যে মোটা হাড় থাকে সেখানে ফ্র্যাকচার হয়েছে। তার কলার বোন ভেঙে গেছে। ভাঙা জায়গায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। তবে কোনো ধরনের ইন্টারনাল ইনজুরি আমরা পাইনি। শিশুটির ওজন তিন কেজির চেয়ে সামান্য বেশি। সে মাশাল্লাহ সুস্থ আছে। কিন্তু যেভাবে সাংবাদিকসহ মানুষজন ভিড় করছে, তাতে নবজাতক তো, কোনো ইনফেকশন হয়ে যায় কিনা সেটা নিয়ে আমরা কিছুটা শঙ্কিত।
তিনি জানান, এখন শিশুটির দেখভাল করছেন হাসপাতালটির মালিকের স্ত্রী ও সেখানে কর্মরত কয়েকজন নার্স। তাছাড়া হাসপাতালটিতে সন্তান জন্ম দেয়া কয়েকজন প্রসূতি শিশুটিকে ভাগ করে বুকের দুধ পান করাচ্ছেন।
মৃত জাহাঙ্গীর আলমের চাচাতো ভাই শরীফ উদ্দিন বলেন, বাবা-মায়ের মৃত্যুর কারণে এখনো শিশুটির নাম রাখা হয়নি। আমরা ওই পর্যন্ত ভাবতেও পারিনি। আমার ভাই নিজে এক সময় পেশায় গাড়ির চালক ছিল। ত্রিশাল এলাকায় নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটতে দেখে বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার পর সে গাড়ি চালানোর কাজ ছেড়ে দেয়। ওদের এইভাবে মৃত্যু আমরা ভাবতেও পারছি না।
এখন শিশুটির দায়িত্ব কে নেবে তা নিয়ে গতকাল উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চেও বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে।
এদিকে শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক চিকিৎসাধীন ওই শিশুকে দেখতে গিয়ে শিশুটির চিকিৎসাসহ ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, শিশুটির চিকিৎসা খরচসহ ভবিষ্যতের জন্য তার নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নিহতের স্বজনরা জানান, জাহাঙ্গীর ও রত্না বেগমের দশ বছর বয়সী মেয়ে জান্নাত ও সাত বছর বয়সী ছেলে এবাদত রয়েছে। মা-বাবা ও বোনকে হারিয়ে এখন তারা নির্বাক।
শনিবার রাতে উপজেলার রায়মনি গ্রামে নিজ বসতঘরের পেছনে পাশাপাশি তিন কবরে দাফন করা হয় জাহাঙ্গীর আলম (৪০), স্ত্রী রত্না বেগম (৩২) ও তাদের ৬ বছরের মেয়ে সানজিদাকে।
ওই পরিবারে বারবার মৃত্যুর হানা : জানা গেছে, অতীতেও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ওই পরিবারের কয়েকজন সদস্য। জাহাঙ্গীর আলমের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই সড়ক আমারে শেষ করে দিছে। আমার দুইটা ছেলেরে নিছে। আমার ছোট ভাইডারে নিছে। ছেলের বউ, নাতনিকে নিছে। আর না জানি কারে কারে নেয়। ছেলে, বউমা ও নাতনিকে হারিয়ে শোকার্ত জাহাঙ্গীরের মা সুফিয়ার কান্না থামছে না।
জানা গেছে, ২০০৪ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা যান তার ছোট ছেলে শামসুল হক। ১৯৯৫ সালে ওই সড়কেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ছোট ভাই ফজলুল হকের। আর এবার আরও এক ছেলে, বউমা ও নাতনির প্রাণ কেড়ে নিল ওই সড়ক।