পটিয়ার ভাটিকাইন গ্রামে বেড়ে উঠা তাঁরা কয়েকজন। তপন, নেপাল, মৃদুল, উৎপল, বাবু। পড়াশুনা নলিনীকান্ত মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউটে। গ্রামের ধুলো–মাটিতে বেড়ে ওঠা এই বন্ধুদের স্মৃতি কখনো ভুলে যাবার নয়। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ সবকিছুই এলোমেলো করে দিল। বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। তপন চলে এলো চট্টগ্রাম শহরে। ভর্তি হলো চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে সখ্যতা হলো টুটুল–অনিমেষের সাথে। গানের জগতে এলো তপন। তারপর তো ইতিহাস অন্যরকম হয়ে গেল। পটিয়ার ভাটিকাইন গ্রামের এই তপন–ই হলেন আজকের দেশের বরেণ্য সংগীত শিল্পী তপন চৌধুরী। বর্ণাঢ্য সংগীত জীবন তাঁর। বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। গত ১৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে চট্টগ্রাম আসেন তপন চৌধুরী। সেইদিন চিটাগং ক্লাবে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বন্ধুদের, প্রিয়জনদের। এলেন ভাটিকাইন গ্রামের বন্ধুরা। ” ‘কেমন আছিস বন্ধু’– বলে জড়িয়ে ধরলেন তাঁদের। এঁদের সাথে দেখা হলো প্রায় চল্লিশ–পঁয়তাল্লিশ বছর পর। সে–এক বড় ভালো লাগার দৃশ্য।
শ্রদ্ধা নিবেদন
সুব্রত বড়ুয়া রনিদা, খালিদ আহসান, আবদুস সালাম আদু
এর আগে যতবারই চট্টগ্রাম এসেছেন তপনদা, দেখা করেছেন রনিদা, আদু ভাইয়ের সাথে। ২০২১ সালে করোনা মহামারীকালে চলে গেলেন তাঁরা। তাই এবার চট্টগ্রাম এসে এই দুইজনকে পেলেন না। খালিদ ভাইয়ের লেখা গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিলেন তপনদা। তাই খালিদ ভাইয়ের প্রতি ভালোলাগা ছিল আগে থেকেই। এবারের চট্টগ্রামে এসে এই তিন জনের শূন্যতা অনুভব করলেন তিনি। তপনদার সাথে দেখা করতে ঢাকা থেকে এসেছিলেন মিতি বৌদি (মিতা বড়ুয়া)। তপনদার হাতে তুলে দিলেন রনিদার স্মৃতি হিসেবে দুটো জামা। আপ্লুত তপনদা। আড্ডায় তপনদা রনিদা, আদু ভাই ও খালিদ ভাইকে স্মরণ করলেন।
আঁরার মালেক বদ্দা
দৈনিক আজাদী সম্পাদক সর্বজন শ্রদ্ধেয় জনাব এম. এ. মালেক। সেই সত্তর দশকে গড়ে ওঠা ব্যান্ড সোলস–এর নেপথ্যের অনুপ্রেরণা ও সহায়তাকারী ছিলেন ‘আঁরার মালেক বদ্দা।’ কেউ কেউ জানেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না মালেক বদ্দার এই ভূমিকা। তিনি নীরবে চট্টগ্রামের এমন অনেক তরুণ শিল্পী, সংগঠনকে সহায়তা করেছেন। এখনও করছেন। সেই সময়ের মালেক বদ্দার স্নেহধন্য তপন চৌধুরী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলেন সেই দিনগুলোর কথা। এমনও হয়েছে মালেক বদ্দার বাসায় খাটে ঘুমিয়ে গেছেন। অনেক সময় চেয়ারে না বসে কোলে বসতো ছোট্ট ওয়াহিদ। আর কোহিনূরকে গান গাইতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। এমন মনোরম স্মৃতি আজও ভুলে যাননি তপন চৌধুরী। তাই আড্ডায় উঠে আসে সেই দিনগুলোর কথা। শিল্পী তপন চৌধুরীকে নিয়ে নিজেদের স্মৃতির কথা বললেন জনাব এম এ মালেক, মিসেস কামরুন মালেক, কোহিনূর মালেক, ওয়াহিদ মালেক।
মনোরম আড্ডা
সংগীতশিল্পী তপন চৌধুরী একসময়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাবাসী হলেন। একক সংগীত শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। আধুনিক গান, সিনেমার গান, ক্যাসেট রিলিজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। পরে তিনি কানাডাবাসী হলেন। মন পড়ে থাকে জন্মভূমি চট্টগ্রামে। তাই এবার চট্টগ্রাম আসার আগেই বন্ধু ও একান্ত আপনজনদের সাথে আড্ডার কথা জানিয়েছিলেন। তাই তপনদার ইচ্ছে পূরণ করার জন্য চিটাগাং ক্লাবে আয়োজন করা হয়েছিল তপনদার ভক্ত–অনুরাগী স্থপতি আশিক ইমরানের আন্তরিক সহায়তায়।
শৈশবের বন্ধু নেপাল, মৃদুল, উৎপল, বাবু, টুটুল, অনিমেষ বন্ধু তপন চৌধুরীকে এত বছর পর কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত। বন্ধু দেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী। তাতে কী ভুলে যায়নি! তাঁদের কথায় সেই প্রসঙ্গ উঠে আসে।
মমতাজুল হক লুলু ভাই সুরেলা ও সোলস–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনিও তপনদার ডাকে ছুটে এলেন। ১৯৭২/৭৩ সালে সুরেলা ও সোলস–এর গঠনকালের স্মৃতি রোমন্থন করলেন। তপনদার বন্ধু সংগীত শিল্পী সাইফুদ্দীন মাহমুদও এলেন। তিনিও তাঁর ভালো লাগার অনুভূতির কথা বললেন।
আড্ডায় আরও অনুভূতি প্রকাশ করেন স্থপতি আশিক ইমরান, কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, নতুন প্রজন্মের সংগীত শিল্পী শুভ দাশ।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ : রনিদা ও আইয়ুব বাচ্চু ভাই
সুব্রত বড়ুয়া রনিদার অনুপ্রেরণায় আজকের এই তপন চৌধুরী। এই কথা বিনীতভাবে বলেন তপনদা। তাই চট্টগ্রামে এসেই ছুটে গেলেন মোহরাস্থ বৌদ্ধ মহাশ্মশানে। যেখানে চিরবিদায় নিলেন রনিদা। রনিদার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করলেন।
তপনদার সংগীত জীবনে আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের ভূমিকাও অপরিসীম। সোলস–এর অনেক জনপ্রিয় গানের সুরকার বাচ্চু ভাই। আবার তপনদার প্রথম একক গানের ক্যাসেট ‘মনে করো তুমি আমি’–এর সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু ভাই। তাঁদের সম্পর্কও ছিল একান্ত ঘনিষ্ঠ। ১৮ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ বাচ্চু ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী। সেইদিন সকালে বাচ্চু ভাইয়ের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন।
পুনশ্চ
সেইদিনের আড্ডায় আমাদের প্রিয় শিল্পী তপন চৌধুরীকে পেয়ে আসলেই ভালো লেগেছে। তপনদাও নানান স্মৃতি রোমন্থনে পরিবেশকে আনন্দময় করে তোলেন। আবার কবে হবে এমন আড্ডা? কবে আসবেন শিল্পী তপন চৌধুরী? প্রতীক্ষায় থাকলাম।