কেবল সনদপত্র নয়, বেকারত্ব নিরসনে গড়ে তুলতে হবে দক্ষ জনশক্তি

রেজাউল করিম স্বপন | সোমবার , ২৯ নভেম্বর, ২০২১ at ৮:১০ পূর্বাহ্ণ

বুয়েট থেকে পাস করা আমার পরিচিত দুইজন ইঞ্জিনিয়ার বিগত দুই বছর যাবত বেকার। পছন্দমত কোনো চাকুরী না পাওয়ায় দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ বুয়েটে যারা পড়ে তারা দেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তান। তাদের পিছনে রাষ্ট্রের লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়। যা এ দেশের গরীব জনগণের ট্যাক্সের টাকা। তাই এই মেধাবীদের বিদেশ গমন ঠেকানো ও দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো অতিব জরুরি। কিন্তু সে কাজটি আমরা যথাযথভাবে করতে পারছি না। শুধু যে বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ারেরা বেকার তা কিন্তু নয়। দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাস করা হাজার হাজার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরাও বেকার। সমপ্রতি এই তথ্যটি উঠে এসেছে সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণায়। গবেষণায় দেখা যায়, দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার। গবেষণায় আরো দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩.৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭.৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে ও ১৮.১শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটির মহা পরিচালকের নেতৃত্বে একটি দল ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে ফেসবুক ও ই-মেইলের মাধ্যমে এই অনলাইন জরিপ পরিচালনা করেছেন। জরিপ অনুযায়ী শিক্ষা শেষে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত বেকার ১১.৬৭ শতাংশ, দুই বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে বেকার ১৮.৫ শতাংশ। ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বেকার ১৯.৫৪ শতাংশ। শুধু বিআইডিএসের গবেষণায় নয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপেও দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪.২ শতাংশ বেকার বলে জানানো হয়। তবে বাংলাদেশে বেকারত্বের ভয়াবহতা জানতে কোনো জরিপের প্রয়োজন হয় না। বিসিএস কিংবা অন্য কোনো খাতে একটি শূন্য পদে চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা দেখলেই সেটি অনুমান করা যায়। কেবল বিআইডিএস বা বিবিএসের জরিপ নয়, দেশি বিদেশি প্রায় সব জরিপ ও পরিসংখ্যানে বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের তথ্য উঠে এসেছে। কয়েক বছর আগে ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের জরিপেও বলা হয়েছিল, বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সর্বোচ্চ। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে এটি আনন্দের। কিন্তু সেই শিক্ষিতের বড় একটি অংশকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। অথচ দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করাই হলো শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য। শিক্ষার পেছনে শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও বিপুল বিনিয়োগ থাকে। তাই শিক্ষিতের এক-তৃতীয়াংশ বেকার থাকলে সেই শিক্ষাকে আমরা মানসম্মত বা যুগোপযোগী শিক্ষা বলতে পারি না। ইতিপূর্বে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের বর্ধিত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। তাদের মতে ২০৩০ সালে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছাবে, যা হবে জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ। তখন এর সুফল পেতে হলে প্রত্যেক নাগরিককে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে ও তাদের জন্য উপযুক্ত কাজের সংস্থানও করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো,আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, কেন আমরা দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারছি না? এর প্রধানতম কারণ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভীত ও মান শক্ত না করে একের পর এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। ফলে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সনদ বিতরণ করলেও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই বাংলাদেশে প্রচুর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকার থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে নিয়োগকর্তার যুক্তি হলো দেশে দক্ষ কর্মঠ জনশক্তির অভাব রয়েছে। এতে বুঝা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের সাথে তাল মিলাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয় গুলো নতুন নতুন বিভাগ ও অনুষদ খুলছে কিন্তু সেসব বিভাগ ও অনুষদ থেকে মানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না। মূলত তিনটি কারণে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রথমত চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা। চাকরির বাজারে যে চাহিদা রয়েছে, সে চাহিদামত লোক তৈরি করতে না পারা।
আর প্রতিবছর যেসব শিক্ষিত লোক চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছে, তাঁদের উপযোগী চাকুরি না থাকা। গত ১০ বছরে দেশে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ১০বছর আগেও বছরে ২ থেকে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির বাজারে যুক্ত হতেন। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে চার-পাঁচ লাখে উন্নীত হয়েছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ শিক্ষিত চাকরি প্রার্থীরা শহরে শোভন কাজ করতে চান। কিন্তু শহরে যত চাকরিপ্রার্থী প্রতিবছর তৈরি হচ্ছে, সেই পরিমাণ চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। বর্তমানে দেশে চাকুরির সুযোগ বাড়ছে উৎপাদনশীল ও কৃষি খাতে। এই দুটি খাতে আবার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস তরুণদের কাজের সুযোগ কম। এই দুই খাতে কারিগরি ভাবে দক্ষ লোকের চাহিদা বেশি। এদিকে গত পাঁচ-সাত বছরে তরুণ চাকরি প্রার্থীদের চিন্তা ও পছন্দের জায়গাতেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। একসময় শিক্ষিত তরুণেরা ভালো বেতনের আশায় বেসরকারি চাকরির প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন, এখন সরকারি চাকরিতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ফলে সবাই ঐদিকে ঝুকছে। মেধাবী ও শিক্ষিত তরুণেরা বেসরকারি চাকরির বদলে সরকারি চাকরিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ভালো ভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তারা স্বেচ্ছায় বেকার থাকার পথকে বেছে নেন। অন্যদিকে আগে শিক্ষিত লোকজন প্রথমে যে চাকুরীটি পেতো সেটাতে যোগদান করে, পরে ভাল কোন জবের চেষ্টা করতো। কিন্তু এখনকার চাকুরী প্রার্থীরা সেই কষ্টটুকু করতে নারাজ। তারা পছন্দসই চাকুরী না পেলে জয়েন করতে চায় না।
দেশে যখন লাখ লাখ শিক্ষিত লোক বেকার তখন ২০ হতে ২৫ লাখ বিদেশী লোক এদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মফস্বলের কারখানাগুলোতে চাকুরীর জন্য শিক্ষিত ও দক্ষ লোক পাওয়া যায় না। সব শিক্ষিতের ঢাকা ও বিভাগীয় শহরেই চাকুরী চাই। অথচ মফস্বলে চাকুরীর জন্য বিদেশ হতে অনায়াসে লোক পাওয়া যায়, কারণ বিদেশীর কাছে ঢাকা শহরে চাকুরী করা আর মফস্বলে চাকুরী করা একই, দুটোই প্রবাস জীবন। আবার কোন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় দেশীয় লোক নিয়োগ দিলে, সে বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান বা সাপ্লাইয়ারের কাছ থেকে কমিশন আদায় করে। অথচ বিদেশী কাউকে নিয়োগ দিলে সে ঐ অনৈতিক কাজটি করে না। যদিও তার বেতন দেশীয় লোকের চেয়ে অনেক বেশী। আর একটি বিষয় হলো দেশীয় লোকেরা চাকুরীতে ফাঁকি দেয়।
এক্ষেত্রে বিদেশের লোক অনেক বেশী কর্মঠ, দক্ষ, কমিটেড ও একাগ্রতা সম্পন্ন। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, নির্মাণ শিল্পের বিভিন্ন কারিগরি কাজ বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের মিস্ত্রির কাজের জন্য দক্ষ লোকের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও মানসম্পন্ন দক্ষ লোক পাওয়া যায় না। আবার বিভিন্ন গ্যরেজ, ওয়ার্কসপ ও কারখানার কারিগরের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দক্ষলোক পাওয়া যায় না। অথচ দেশে বেকার লোকের অভাব নেই। অর্থাৎ চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা না করে শুধু পুঁথিগত শিক্ষা দিয়ে দেশের জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখী করা যাবে না। তবে এর সমাধান হতে পারে কারিগরি শিক্ষাকে যদি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক করা হয়। জেনারেল বিষয়গুলোতে ডিগ্রি বা স্নাতক পড়া শিক্ষার্থীকে যেকোনো একটি কারিগরি বিষয়ে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমেও এর সমাধান করা যায়। সরকার প্রতিটি সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট দিতে পারে, তারা যেন নির্দিষ্টসংখ্যক ‘ফ্রেশ’ গ্র্যাজুয়েটকে প্রতিবছর তিন থেকে ছয় মাসের জন্য ইন্টার্ন হিসেবে নিয়োগ দেয়। সরকার প্রয়োজন বোধে তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ভাতার ব্যবস্থা করতে পারে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো তরুণদের সুযোগ দিতে উৎসাহিত হবে। পরবর্তীতে প্রশিক্ষিতদের মধ্যে থেকেই সেই প্রতিষ্ঠানের দক্ষ লোকের চাহিদা পূরণ করা যাবে। এতে একদিকে যেমন দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে, অন্যদিকে অনেক নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। এর সাথে চাকুরী প্রার্থীদের মন মানসিকতারও পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, কর্ম জীবনের শুরুতে ছোট বড় যে কোনো কাজ, যে কোনো জায়গায় হোক না কেন তা নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে করতে হবে, না হলে জীবনে সফলতা আসবে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি আবেদন
পরবর্তী নিবন্ধআবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ