কেন এত যানজট, কার কী যুক্তি

সড়কে ধীর গতি, স্থবির নগরীর জীবনযাত্রা

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

যানজটের কবলে পুরো নগরী স্থবির হয়ে পড়েছে। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে বিকেল, এরপর সন্ধ্যা গড়াতেই স্থির হয়ে যায় পুরো নগরী। ধীর গতিতে চলতে চলতে কোনো মতে গন্তব্যে যেতে হয় যাত্রীদের। এভাবেই চলছে নগরীর যানবাহন। সঙ্গে যোগ হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ, দুর্বিষহ ভোগান্তি আর সময়ের অপচয়। যানজট নিরসনে ইতোমধ্যে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্রতিটি পদক্ষেপই ক’দিন যেতে না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে। নগরী যানজট নিয়ে চলছে নানা পক্ষের নানা মন্তব্য। ট্রাফিক বিভাগ বলছে, জনবল সংকটের কারণে যথাযথ কাজ করা যাচ্ছে না। যাত্রীরা বলছে, ট্রাফিক পুলিশ ঠিক মত দায়িত্ব পালন করছে না। নিজেরা নিজেদের মত করে বসে, দাঁড়িয়ে থেকে দায়িত্ব পালন করছে। অন্যদিকে, নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সড়ক ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকা, গাড়ি থামার নির্দিষ্ট স্টেশন না থাকা, নিয়ম মেনে গাড়ি না চালানোর কারণেই মূলত নগরীতে নিয়মিত যানজট হচ্ছে।

যানজট বাড়ার জন্য অনুমোদনহীন গাড়ি রাস্তায় নামানো এবং গ্রাম থেকে শহরে রিকশার উপস্থিতি বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেছে নগর পুলিশ প্রশাসন ও পরিবহন মালিক সংগঠনের নেতারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইদানিং বিভিন্ন মফস্বল এলাকার রিকশা ও সিএনজি টেক্সি বিনা বাধায় শহর ও শহরতলিতে ঢুকে পড়ছে। ফলে নগরীর বিপণি বিতান সংলগ্ন সড়ক ও শহরতলির অক্সিজেন, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, অলংকার মোড় এলাকায় যানজট দিন দিন বাড়ছে। পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি সত্ত্বেও গ্রাম থেকে আসা রিকশা ও অনুমোদনহীন গাড়ি চলাচলের কারণে যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন পরিবহন মালিক সংগঠনের নেতারা। তাঁদের আশঙ্কা, রিকশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। আর মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি বন্ধ রাখার দায়িত্ব নগর পুলিশের।
গত দু’দিন নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর প্রাণকেন্দ্র নিউমার্কেটকে কেন্দ্র করে আশপাশের প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার এলাকা, বহদ্দারহাটের আশপাশেও প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার এলাকা দিনের বেশিরভাগ সময় যানজটে স্থবির হয়ে আছে। এর বাইরে নগরীর দেওয়ানহাট মোড় থেকে আগ্রাবাদ, বন্দর হয়ে সিইপিজেড মোড় পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকায়ও সৃষ্টি হচ্ছে অস্বাভাবিক যানজটের।
নগরীর আগ্রাবাদ-হালিশহর এক্সেস রোডের বেশির ভাগ সড়ক ক্ষতবিক্ষত ও খানাখন্দে ভরা। সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। অনেক সময় বড় গর্তগুলো পার হতে যানবাহন আটকে যায়। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। একদিকে সড়কে বড় বড় গর্ত এবং অন্যদিকে তীব্র যানজট। তাছাড়া রাস্তার দুই ধারে কিছু অংশে চলছে ড্রেন সংস্কারের কাজ। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্রায় সময় সড়কের গর্তগুলোতে পানি জমে থাকে। বিশেষ করে এ সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী নগরীর আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, রহমানবাগ গুলবাগ, শান্তিবাগ, বেপারিপাড়া, হালিশহর, বড়পুল ও ছোটপুল এলাকার লাখো বাসিন্দাসহ পথচারীদের দুর্ভোগের শেষ নেই।
যানজট নিয়ন্ত্রণে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ মানুষ আর যানবাহনের স্রোত ঠেকাতে পারছে না কিছুতেই। নিউ মার্কেট হচ্ছে চট্টগ্রামের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। পর্যাপ্ত ও প্রশস্ত রাস্তা থাকলেও, তার অনেকটাই হকারদের দখলে। এছাড়াও রয়েছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং। ফলে নিত্যদিন যানজটের এমন দৃশ্য এখানে দেখা যায়। শুধু নিউমার্কেট এলাকাই নয়, বন্দর ভবন, আগ্রাবাদ, বাদামতলী, চৌমুহনি মোড়, দেওয়ানহাট, বিআরটিসি মোড়, বহদ্দারহাট, অলংকার মোড়, অঙিজেন, শাহ আমানত সেতু এবং ইপিজেড এলাকাতেও রয়েছে এমন যানজট। ফলে নগরবাসীকে শিকার হতে হয় ভোগান্তির। পথচারীরা বলেছেন, হকারদের জন্য ফুটপাত দিয়ে হাঁটা যায় না। প্রশাসন তৎপর হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
যানজট প্রসঙ্গে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ জানান, যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের মাঠ পর্যায়ের সার্জেন্ট কন্সটেবলরা দিনরাত পরিশ্রম করছে। পাশাপাশি সিনিয়র কর্মকর্তারাও অনেক সময় যানজট নিরসনে মাঠে সক্রিয় থাকে, যাতে নগরবাসীর দুর্ভোগ একটু লাঘব হয়। আমাদের দিক থেকে চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই।
চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রবেশ মুখগুলোতে যানজট যেন স্থায়ী রূপ পেয়েছে। অঘোষিত স্ট্যান্ড, বেপরোয়া প্রতিযোগিতাসহ নানা অব্যবস্থাপনা তো রয়েছেই, সাথে আছে পুলিশ ও পরিবহন মালিক শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি। নগরীর প্রবেশ মুখের মধ্যে রয়েছে কর্ণফুলী তৃতীয় সেতু, কালুরঘাট রেল সেতু, অঙিজেন মোড়, সিটি গেট এলাকা। চট্টগ্রামে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার ক্ষেত্রে এসব স্পট দিয়ে যেতে হয়। স্পটগুলোতে রাস্তার উপর যানবাহন রেখে যাত্রী ওঠা-নামা, যত্রতত্র গাড়ি রাখা, একইসাথে যাত্রী পরিবহনে অসম প্রতিযোগিতার কারণে আটকে থাকে পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহন। অভিযোগ রয়েছে, যানজটে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকলেও কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ ও থানা পুলিশ ব্যস্ত থাকে তল্লাশীতে। পরিবহন মালিক সংগঠনগুলোর বেতনভুক্ত কিছু কমিউনিটি পুলিশ থাকে, তবে তারা-ইবা বসে থাকে কেন? দিনের পর দিন ধরে এ দুর্ভোগ পোহাতে হলেও তার কোন সমাধান মিলে না কারো কাছে।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ইতোমধ্যে নগরীর যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যানজট নিরসনে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পুলিশের বিশেষ কর্মসূচি নেয়া হলেও এসবের কোন সুফল দৃশ্যমান হচ্ছে না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষও যানজট নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছিল, এখন কিন্তু তা দৃশ্যমান নয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের প্রধান নগর ঢাকা ও চট্টগ্রামে যানজট নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া না হলে কয়েক বছর পর এ দুটি শহরে চলাচলকারী যানবাহনের গতি মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কমে যাবে। কাজেই যানজট সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে।
যানজট নিরসনে করণীয় প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার মজুমদার সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত অপ্রতুল উল্লেখ করে বলেন, শুধু যানবাহন নিয়ে চিন্তা করলে হবে না। একটি গাড়িতে কত যাত্রী সংকুলান হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে আমাদের। বেশি যাত্রী সংকুলান হয় এমন গাড়ির সংখ্যা অবশ্যই বাড়াতে হবে। আর চালকরা গাড়ি চালানোর সময় তো নিয়ম কানুনের কোনো তোয়াক্কা করেন না। নিয়ম না মেনেই তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ওভারটেক করে। ফলে যানজট সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, আমাদের মহানগরে নির্দিষ্টস্থানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠা-নামার জন্য কোনো স্টেশন নেই। সড়কের উপর দাঁড়িয়েই যাত্রী উঠা-নামা করা হয়। এছাড়া সড়কের তুলনায় এখন যানবাহনের সংখ্যা তো অনেক বেশি। তিনি বলেন, সড়কে গাড়ি, পথচারীদের হাঁটার জন্য আলাদা লেন থাকা উচিত। নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে না। সড়কগুলোতে আলাদা লেন না থাকায় সবাই এক সাথে হাঁটছে। এ অবস্থায় যানজট হওয়া স্বাভাবিক। এটি আরো বাড়বে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএটা সোমালিয়া-ইথিওপিয়া নয় যে ভোটে জাতিসংঘের সহায়তা লাগবে : তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধকরোনায় চট্টগ্রামে নতুন আক্রান্ত ৭৬, ১ জনের মৃত্যু