মধ্যস্বত্বভোগী মিল মালিক সিন্ডিকেটের কারণে দেশীয় লবণ উৎপাদন শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। জমি বর্গা নেওয়া, পলিথিন ক্রয়, শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে উৎপাদিত লবণ বিক্রি করতে গিয়ে দেখা যায় লাভের মুখ দেখা দূরের কথা, বিনিয়োগকৃত পুঁজিও তুলতে পারছেন না চাষিরা। অনেকে বাধ্য হয়ে কম মূল্যে উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে দিলেও অনেক চাষি দরপতনের কারণে উৎপাদিত লবণ মাঠের গর্তে, গুদামেই মজুদ করে রাখছেন।
সূত্র জানায়, বিগত ১৭ বছরের মধ্যে দেশীয় লবণ চাষিরা এমন বিপর্যয়ের সম্মুখীন আর হননি। প্রতি কেজি লবণ উৎপাদনে ৭–৮ টাকা খরচ হলেও বিপরীতে বিক্রি করে বর্তমানে মিলছে মাত্র ৩ থেকে সাড়ে ৩ টাকা। এতে লগ্নিকৃত অর্থ তোলা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তা ভর করেছে চাষিদের মাঝে। এই পরিস্থিতিতে দেশীয় লবণশিল্পকে বাঁচাতে এখনই সরকারের কঠোর পদক্ষেপ আশা করেছেন চাষিরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কঙবাজারের ৭ উপজেলা এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে গত মৌসুমে উৎপাদিত লবণ এখনো মাঠের গর্তে এবং বিভিন্ন গুদামে পড়ে রয়েছে। বর্তমানে দেশের শিল্প এবং ভোক্তা খাতে লবণের কোনো ঘাটতিও নেই। দেশের মিল–কারখানায় যে পরিমাণ লবণ মজুদ আছে তা দিয়ে আরো কয়েক মাস চলবে। তার ওপর চলতি মৌসুমেও উৎপাদনের ধুম পড়েছে মাঠে মাঠে। আগামী মে মাস পর্যন্ত এই লবণ উৎপাদন অব্যাহতভাবে চলবে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন করেন কঙবাজার জেলার চাষিরা। উখিয়া ও রামু ছাড়া বাকি ৭ উপজেলায় লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র–কুটির শিল্প (বিসিক) জানায়, ২০২৪ সালের লবণ উৎপাদন মৌসুমে কঙবাজারের ৭ উপজেলা তথা চকরিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, ঈদগাঁও, কঙবাজার সদর, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও পটিয়ার সামান্য জমিতে পলিথিন ও সনাতন পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে। তদ্মধ্যে শুধুমাত্র কঙবাজার অঞ্চলেই মোট ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৯০ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে, যা বিগত ৬৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড লবণ উৎপাদন। এর আগে ২০২৩ সালের মৌসুমে দেশে প্রায় ২২ লাখ ৩৩ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়েছিল। তখন উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিও নিশ্চিত ছিল। এতে চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদনের চাষযোগ্য জমির পরিধির পাশাপাশি চাষির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়।
বিসিকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছর দেশে মোট ৬৬ হাজার ৪২০ একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছিল। চলতি বছর যার পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর। সেই হিসেবে চাষের জমি বেড়েছে ২ হাজার ৮১ একর। এছাড়া চলতি বছর আবাদযোগ্য জমিতে মোট ৪০ হাজার ৬৯৫ জন কৃষক লবণ চাষ করছেন, যা গত বছরের চেয়ে ১ হাজার ২২৮ জন বেশি।
২০২৪ সালের মৌসুমে উৎপাদিত প্রতিমণ লবণ বিক্রি করে চাষিরা পেয়েছিলেন ৩৮০–৪০০ টাকার মধ্যে। মৌসুমের শেষার্ধে এসে লবণের মণপ্রতি দাম কমে ২৯০–৩০০ টাকার মধ্যে নেমে আসে। তবে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া অজুহাত তুলে কম সরবরাহ দেখিয়ে বিদেশ থেকে এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার।
মিল মালিক সিন্ডিকেট ও সরকারের প্রতিনিধি সংস্থা বিসিকের (কঙবাজার) সমন্বিত ষড়যন্ত্রে দেশের লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অভিযোগ করে সম্প্রতি কঙবাজার লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদ এক জরুরি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। চাষি ও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বলেন, চলতি মৌসুমে মাঠ পর্যায়ে কেজিতে লবণের দাম নেমেছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ টাকায়। কিন্তু প্যাকেটজাত করে সেই লবণ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। এতে খুচরা মূল্যে রয়ে যাচ্ছে বিরাট ফারাক। দালাল–মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেট ভারী হলেও বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক চাষিরা। তাই সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপই এই শিল্পকে বাঁচাতে পারে। যোগ করেন প্রান্তিক চাষিরা।
কঙবাজারে মতবিনিময় সভায় সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এ এইচ এম শহিদ উল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশে উৎপাদিত লবণের বর্তমান মজুদ দিয়ে দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে আগামী বছরও চালানো যাবে। চাহিদার বিপরীতে বিপুল পরিমাণ লবণ মজুদ থাকলেও লবণ মিল মালিক সমিতির নাম দিয়ে একটি অকার্যকর সিন্ডিকেট আবারও সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে। তাই দেশীয় লবণশিল্পবিরোধী ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
চকরিয়ার পশ্চিম বড় ভেওলার দরবেশ কাটা গ্রামের লবণ চাষি ফরিদুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, বিদায়ী বছরেও উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে ভালই দাম পান। তাই এবারও আগ্রহভরে লবণ উৎপাদনে মাঠে নামেন প্রান্তিক চাষি। কিন্তু সেই আগ্রহ বর্তমানে গলার কাটায় পরিণত হয়েছে। প্রান্তিক এই চাষির দাবি, মৌসুমের শুরুতে প্রতিমণ লবণ বিক্রি করে ২৫০ টাকা পেলেও বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৩০ টাকার মধ্যে। উচ্চ মূল্যে জমি লাগিয়ত, পলিথিন, শ্রমিকসহ খরচের বিপরীতে পুঁজির টাকাও তোলা যাচ্ছে না। ঋণ আর দাদন নিয়ে লবণ চাষ করে এখন সংসার চালানোও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই লোকসানের পরিমাণ কমাতে অধিকাংশ লবণ চাষি উৎপাদিত লবণ মাঠেই গর্তে ও গুদামে মজুদ করছেন।
খুটাখালীর নয়াপাড়া লবণ চাষি নেয়ামত উল্লাহ, ডুলাহাজারার কাটাখালীর ছৈয়দ আহমদ বলেন, লবণ উৎপাদনে খরচের অর্ধেক দামও পাওয়া যাচ্ছে না। দালাল ছাড়া যেসব চাষি লবণ চাষ করছেন তারা পাচ্ছে ১৪০–১৫০ টাকা। যদি কিছুটা দাম বাড়ে সেই আশাতেই মাঠের গর্তে–গুদামে মজুদ করছেন উৎপাদিত লবণ।
দেশের মধ্যস্বত্ত্বভোগী মিল মালিকদের সঙ্গে আঁতাতের বিষয়ে লবণ চাষি ও সংগ্রাম পরিষদের তোলা অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য বিসিক কঙবাজারের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।