বান্দরবানের রুমা–থানচিতে সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের ব্যাংকে হামলা, অস্ত্র ও অর্থ লুটের ঘটনায় সার্বিক পরিস্থিতি পরিদর্শনে এসেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। গতকাল রোববার সকালে হেলিকপ্টারে তিনি বান্দরবান পৌঁছান। তিনি রুমা ও থানচির পরিস্থিতি ঘুরে দেখেন। পরে বান্দরবান ৬৯ সেনা রিজিয়নে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করেন। মতবিনিময় শেষে দুপুর সাড়ে ১২টায় বান্দরবান সেনা রিজিয়ন মাঠে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে সেনাপ্রধান বলেন, কেএনএফ সশস্ত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে কম্বাইন্ড অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ২টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর অভিযান চলবে। তিনি বলেন, কেএনএফের সবগুলো আস্তানা সেনাবাহিনী গত বছর দখল করে নিয়েছিল। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমিয়ে ফেলেছিল। পরবর্তীতে শান্তি কমিটির সঙ্গে কেএনএফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছিল। দুটি মুখোমুখি সংলাপ বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে কেএনএফ ও শান্তি কমিটির। তৃতীয় বৈঠকের আগেই তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাল। বমদের সানডে আয়োজনে ৩১ মার্চ রুমায় বেতেলপাড়াসহ সবগুলো গির্জায় সেনাবাহিনী কেক পাঠিয়ে উৎসব আয়োজনে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু ২ এপ্রিল তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাল। মনের ভিতরে কি আছে সেটি তো জানা মুশকিল, তাই না? শুরুতে আমরা তাদের বিশ্বাস করেছিলাম, শান্তি আলোচনা চলছে, শান্তিতেই সবকিছু শেষ হবে। কিন্তু কেএনএফ বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে, বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠেছে। পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে, আমরা প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
তিনি আরও বলেন, কম্বাইন্ড অপারেশন এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমও চলছে। তাই অপারেশনের সবগুলো দৃশ্যমান নয়। কিছু কার্যক্রম অদৃশ্যে চলবে, যা সাধারণ মানুষ দেখবে না। কিন্তু জনগণ শান্তির সুফল ভোগ করবে। সশস্ত্র সংগঠনগুলোর তৎপরতা বন্ধে সব ধরনের সক্ষমতা সেনাবাহিনীসহ আইনশৃক্সখলা বাহিনীর রয়েছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করতে হচ্ছে। কারণ কেএনএফে বম জনগোষ্ঠীর সকলে জড়িত নয়। কিছু সংখ্যক বিপথগামী কেএনএফ সদস্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো চালাচ্ছে। বম জনগোষ্ঠী শান্তিপ্রিয়, তারা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায়।
বিডিনিউজ জানায়, সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা এখন সরকারের ওভারঅল স্ট্র্যাটেজি, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে যেভাবে এটা সরকার চিন্তা করেছে, বাংলাদেশ সরকারের সমস্ত অর্গান, আমাদের সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ এবং অন্যান্য ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন, সব সমন্বিতভাবে আমরা এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করব। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে দায়িত্বগুলো পালন করার, বিশেষ করে যৌথ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া, সেইগুলো আমরা অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে করতে পারব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি আপনাদের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চাই, আমার কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা খুবই পরিষ্কার। বাংলাদেশের জনগণের শান্তির জন্য, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য যা করণীয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ, সেটাই করতে হবে। আর সেটা বাস্তবায়নে সক্ষম হব বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছি।
প্রথম ব্যাংক ডাকাতির পর পাঁচ দিন হয়ে গেছে, সেনাবাহিনী জরুরি কোনো অভিযান করেছে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আপনার বুঝতে হবে, এখানে যদি একটা ফোর্স ডিফেন্স নিয়ে থাকত, আমি গিয়ে অ্যাটাক করে দিলাম। এ রকম কেউ ডিফেন্স নিয়ে কোথাও আছে? আপনি জানেন কোথায় কে লুকিয়ে আছে? বাংলাদেশের পাড়ার ভেতর, জনগণের ভেতর কেউ যদি লুকিয়ে থাকে, বাংলাদেশের মানুষের উপর যেয়ে আমরা কি হামলা করব? সো আমাদের তথ্য নিশ্চিত হতে হবে কোথায় কে আছে, ধীরে ধীরে এগুলো ক্ল্যান্ডেস্টাইন অপারেশন, কোনো জায়গায় কমবাইন্ড অপারেশন, কোনো জায়গা যদি ডাইরেক্ট কনফ্রন্টশনে যেতে হয়, সেটা পরিস্থিতি অনুযায়ী যাওয়া হবে। তারা অস্ত্র ফেলে জনগণের সাথে মিশে সারা জায়গায় কোথায় কীভাবে আছে, সেইগুলো আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
কেএনএফ যে হামলা করতে পারে, তেমন কোনো আগাম তথ্য ছিল কিনা, সেই প্রশ্ন সেনাপ্রধানকে করেন সাংবাদিকরা। জবাবে তিনি শান্তি আলোচনার প্রসঙ্গ ধরে বলেন, আগাম তথ্য থাকলে তো আমরা ডেফিনিটলি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতাম। আমরা তো তাদেরকে বিশ্বাস করেছি। তারা তো দুইবার বসেছে শান্তি আলোচনায়। তৃতীয়বারও বসার কথা। তারা কি কোনো সময় বলেছে যে, না এটা হবে না, আমরা এটা করছি না, মানি না।
সেনাপ্রধান বলেন, আপনি বন্ধুত্ব…, সবকিছু ঠিক আছে। ভেতরে ভেতরে আপনি কিছু করলে, মানুষের মনের ভেতরে তো আর ঢোকা যায় না। ভেতরে কোনো কিছু ষড়যন্ত্র করলে একটা…। তবে বমদের সবাই যে এসব ঘটনায় জড়িত না, সে বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, যেটুকু আমি শুনছি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে, সবাই এগুলোতে জড়িত না। কিছু আছে শান্তি চায়, কিছু কিছু আছে তারা চাচ্ছে না। সেগুলোকে এলিমিনেট করা হবে।
কেএনএফ যে তাদের ফেইসবুক পেইজে শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসার বিষয়ে উল্টো প্রশাসনকে দোষারোপ করেছে, সে কথা তুলে ধরে সেনাপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন একজন সাংবাদিক। উত্তরে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, আপনি যখন কোনো অপকর্ম করবেন, তখন তো আপনার চেষ্টাই থাকবে দোষটা অন্যের ঘাড়ে দিয়ে দেওয়ার। আপনারা তো সঠিক জিনিসটা দেখতে পাচ্ছেন। আমি যেটা বলেছি, এর ভেতর কোনোটা তো গল্প বা কিছু না। সবই তো বাস্তব কাহিনী বললাম।
কেএনএফ কী উদ্দেশ্য নিয়ে শান্তি আলোচনা থেকে সরে এল, সেই প্রশ্নে সেনাপ্রধান বলেন, সেটা তারাই বলতে পারবে। আমি সুনির্দিষ্ট করে জানি না। কেন সরে যেতে চাচ্ছে, কী হচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, পাশের দেশের সন্ত্রাসীদের অস্ত্র কেএনএফের হাতে পৌঁছেছে বলে তথ্য পেয়েছেন তারা। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সেনাপ্রধান বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমন্বিত একটি প্রক্রিয়া চলছে। এখানে যার যার কাজের ক্ষেত্র আলাদা। সে কারণে ওই বিষয়ে তিনি কিছু বলতে চান না। আপনাদের যে সমস্ত জিজ্ঞাস্য, যারা কনসার্ন, তাদের কাছ থেকে এটা জানলে ভালো হবে। আমরা একে অন্যের পয়েন্টটা বলা শুরু করলে হয়ত একটা ভুল বোঝাবুঝির জায়গা সৃষ্টি হবে।
পাহাড়ে সেনাবাহিনীর ১৩০টি ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়ায় সেই সুযোগ কেএনএফ নিয়েছে কিনা, সেই প্রশ্নে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, সুযোগ তো কিছুটা নিয়েছে, যেসব জায়গায় গ্যাপ হয়ে গেছে, আমরা সেগুলো কিছু আবার ফিলাপ করছি। সেই সঙ্গে তিনি এও বলেন, যখন পরিস্থিতি অশান্ত হয় তখনই সেনাবাহিনীর দরকার। শান্তির ভেতরে সেনাবাহিনীর কী দরকার? যখন শান্তি থাকবে, তখন তো অসামরিক পরিবেশ, অসামরিক প্রশাসন। তারা সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন করবে, প্রতিটা জায়গায় যা হচ্ছে, তাই হবে। এইসব দৈনন্দিন কাজ তো সেনাবাহিনীর না। যদি অশান্ত হয় তখনই আমাদের দরকার হবে।