কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার নির্মাণ জরুরি

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১১ মার্চ, ২০২৫ at ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

এদেশের কৃষক প্রতিবছর দুইবার কাঁদে। একবার যখন পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করে অতি কম দামে বিক্রি করে তখন, আরেকবার অফ সিজনে যখন একই পণ্য অত্যধিক বেশি দামে কিনে তখন। কথাটি কেন বললাম? কয়েকদিন আগে তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজারচট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালীতে। কয়েকশ প্রান্তিক চাষি কাফনের কাপড় পরে, রাস্তায় লবণ ছিটিয়ে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। এক ঘণ্টা ধরে চলা এই অবরোধ কর্মসূচির কারণে চট্টগ্রামকক্সবাজার সড়কে কয়েকশ যানবাহন আটকা পড়ে। এ সময় নারী ও শিশুকিশোর যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। কয়েক কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

জানা যায়, এ বছর কক্সবাজারের ৬৮ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ করেছেন ৪৪ হাজারের বেশি প্রান্তিক চাষি। প্রতিমণ লবণ উৎপাদনে তাদের ৩৪০ টাকার বেশি খরচ হলেও বিক্রি হচ্ছে ১৮০১৮৫ টাকায়। এ অবস্থায় লবণের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে এই অবরোধ পালিত হয়। জানা যায় খুটাখালী বাজারে চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, বদরখালী, ঈদগাঁও এবং কক্সবাজার সদর উপজেলার কয়েকশ লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে চাষিরা ট্রাকে করে লবণ নিয়ে আসে। এরপর মহাসড়কের ওপর সেই লবণ ছিটিয়ে স্তূপ করে রাখেন। লবণের স্তূপে কাফনের কাপড় পরে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। এই সময় তাঁরা সড়কের দুই অংশ বন্ধ করে দেন। পরে পুলিশ এসে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এ সময় মহাসড়কের দুই পাশে ব্যানারফেস্টুন টাঙিয়ে নিজেদের দাবি তুলে ধরেন লবণচাষিরা। চাষিদের দাবি একটি মহল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট নাম দিয়ে চাহিদার অতিরিক্ত শিল্প লবণ আমদানির চেষ্টা করছে। অবিলম্বে তা বন্ধের দাবি জানান তাঁরা। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার দাবি করেন।

বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, লবণের ন্যায্যমূল্য না পেলে চাষিদের পথে বসতে হবে।

লবণচাষি ও ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, মাঠে প্রতি কেজি লবণ পাঁচ টাকায় কিনে মিলের মালিকেরা সেই লবণ প্যাকেটজাত করে খুচরা বাজারে বিক্রি করছেন ৪০৫০ টাকায়। লবণচাষি ও ব্যবসায়ীদের দাবি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একমাত্র দেশি লবণ উৎপাদনের কেন্দ্র। এর মধ্যে প্রায় ৯৫% লবণ উৎপাদিত হয় কক্সবাজার জেলায় সদর, টেকনাফ, ঈদগাঁও, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া উপজেলায় এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ লবণ উৎপাদিত হয় চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মে) কক্সবাজারের নয়টি ও চট্টগ্রামের একটি উপজেলায় ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। গত মৌসুমে লবণ উৎপাদিত হয়েছিল ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। জানা যায়, কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালে।

বিসিকের কক্সবাজার লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, শতভাগ মাঠে লবণ উৎপাদন হলেও লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন চাষিরা। এর আগেও লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের দাবিতে প্রান্তিক চাষিরা কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়াতে পৃথক বিক্ষোভ সমাবেশমানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।

দফায় দফায় লবণের দাম কমে যাওয়ার কারণ বর্ণনা করে কৃষকরা বলেন, মধ্যস্বত্বভোগী ও কার্গো বোটের মালিকেরা সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। শুধু কুতুবদিয়ার চার হাজারের বেশি চাষি লবণ চাষ করেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে লবণ বিক্রির সুযোগ নেই তাদের। উৎপাদিত লবণ সমুদ্রপথে কার্গো বোটে করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠাতে হয়।

গত বছর এই সময়ে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছিল ৪৫০ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ টাকায়। লবণের দাম না বাড়লে অনেক চাষি উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন। তাতে দেশে লবণের সংকট সৃষ্টি হলে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর প্রতি কানি জমি এক মৌসুমের জন্য (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ৫ মাস) লাগিয়ত (ইজারা) পেয়েছিলেন ৫০ হাজার টাকায়। এবার একলাফে ৩০ হাজার টাকা বেড়ে ৮০ হাজার টাকা করে পরিশোধ করতে হচ্ছে। তা ছাড়া মাঠে পলিথিন বিছানো, উৎপাদিত লবণ পরিবহন ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ খরচ বেড়েছে। যে কারণে প্রতি মণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে চাষিদের খরচ হচ্ছে ৩৪০ টাকার বেশি। প্রতি মণ লবণের দাম কমপক্ষে ৪০০ টাকা না পেলে চাষিরা লবণ চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। তখন উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে লবণ চাষে নামা ৮০% চাষি পথে বসবেন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, দেশে এ বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদাও ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। বিসিক কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেন, আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার পরও চাষিরা লবণ উৎপাদনে অনীহা প্রকাশ করছেন। কারণ লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে কক্সবাজারের কোথাও লবণ মজুত কিংবা সংরক্ষণের গুদাম নেই। চাষিরা নিজ উদ্যোগে উৎপাদিত লবণ মাঠে গর্ত খুঁড়ে সংরক্ষণ করেন। বিসিক ও চাষিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তত ৫ হাজার গর্তে ১ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে দাম বেড়ে গেলে গর্ত থেকে তুলে সেই লবণ বিক্রি হবে। লবণ গুদামে সংরক্ষণ করা হয় না কেন জানতে চাইলে কৃষকরা বলেন, গুদামে লবণ মজুত করলে তা শুকিয়ে যায়। এতে ওজনও কমে যায়। আর গর্তে রাখলে শুকিয়ে যায় না বরং নিরাপদে থাকে। ঝড়বৃষ্টি কিংবা জলাবদ্ধতাতেও গর্তের লবণ নষ্ট হয় না। গর্তের ভেতরে এসব লবণ পলিথিন মোড়ানো থাকে। গর্তের মুখও মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়।

শুধু লবণ নয়। বাংলাদেশে যে কোন পণ্যের উৎপাদনের মৌসুমে পণ্যটির দাম অত্যধিক কমে যায়। কয়েকদিন আগে মুলা, বেগুন, ফুলকপির দাম না পাওয়ায় কৃষক সেটি বাজারে ফেলে চলে যায়। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফলের মৌসুমে প্রচুর ফল নষ্ট হয়ে যায় শুধু সংরক্ষণের অভাবে। বিশেষ করে পার্বত্য জেলাগুলোতে উৎপাদিত অনেক ফল নষ্ট হয় যাতায়াতের অসুবিধা ও সংরক্ষণের অভাবে।

বাংলাদেশ একটি নাতিশীতোষ্ণ দেশ। উষ্ণতা, গরম আবহাওয়া ও আর্দ্রতার জন্য স্বাভাবিকভাবে এখানে কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণ করা সহজসাধ্য নয়। তাই সরকারের উচিত কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা। অন্যদিকে প্রান্তিক কৃষক যেন তার উৎপাদিত পণ্য সহজে সংরক্ষণ করতে পারে সে জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গবেষণা করে সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি বের করা। প্রয়োজনবোধে বিদেশি বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়েও কাজটি শুরু করা যেতে পারে। যাতে উৎপাদনের মৌসুমে কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণ করে কৃষক সারা বছর সেটি বিপণন করতে পারে। এতে প্রান্তিক কৃষক ও সাধারণ জনগণ সহজে ও সুলভ মূল্যে কৃষিজাত পণ্য কিনতে পারবে। আর এটি করা গেলে দেশে কৃষি ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব সাধিত হবে যার সুফল পাবে দেশের আপামর জনসাধারণ।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র মাহে রমজান হলো আল্লাহভীতি অর্জনের মাস
পরবর্তী নিবন্ধশওকত হাফিজ খান রুশ্নি : স্বাধীনতার অগ্নিঋষি ও দ্রোহকালের কবি