আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে তীব্র খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হতে পারে, তার পূর্বাভাস অর্থনীতিবিদরা বহু পূর্বে দিয়ে রেখেছেন। দুই শতাধিক বর্ষ পূর্বে অর্থনীতিবিদ থমাস মালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বে খাদ্যাভাব জর্জরিত ভবিষ্যৎ বিশ্বের রূপ চিত্রায়িত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জ্যামিতিক হার এবং খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির গণিতিক হারের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতাকে খাদ্য সংকটের অবশ্যম্ভাবিতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন ঐ প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ। যাই হোক, বর্তমান বিশ্বে ক্রমপ্রকটমান খাদ্য সংকটকে প্রত্যক্ষভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পায়ন–নগরায়ণ কীভাবে খাদ্য সংকটে এক ভয়াবহ মাত্রার সংযোজন ঘটিয়ে চলেছে সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্পায়ন–নগরায়ণের ফলস্বরূপ বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউস গ্যাস, বিশেষত কার্বন–ডাই–অক্সাইডের মাত্রা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে গোলকীয় তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে এ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ বা তারও আগে। এমতাবস্থায় অ্যান্টার্কটিকা, গ্রীনল্যান্ড তথা হিমবাহের বরফাচ্ছদন দ্রবীভূত হয়ে সমুদ্রের পানি পৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ থেকে ২.৫ মিটার অবধি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এমন ঘটনা যে এক অবর্ণনীয় সুদূরপ্রসারী বিপর্যয় ডেকে আনবে তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। উপকূলীয় অঞ্চল ও অনেক দ্বীপমালা পানিহীন হয়ে যাবে। আক্রান্ত অঞ্চল থেকে ভূ–ভাগের অন্যত্র মারাত্মক হারে বিস্তার ঘটবে। পরিণতিস্বরূপ বেকারত্ব, দারিদ্র তথা খাদ্যসংকট এক বিভীষিকাময় রূপ ধারণ করবে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে আগামী বিশ্বে চরম পানি সংকট দেখা দিবে, যার ফলস্বরূপ খাদ্যসংকট তীব্রতর হবে। পৃথিবীর গাত্র বেয়ে বয়ে চলা নদী–নালার প্রবাহিত পানির উৎস হিমবাহ। হিমবাহ থেকে নিরন্তর প্রবাহ রূপে পানি সাগরে গড়াচ্ছে। আবার সাগর থেকে বাষ্পাকারে এ পানি পূনরায় হিমবাহে জমা হচ্ছে। এ জমাট ও গলন প্রক্রিয়ায় পুরো বিষয়টি চক্রাকারে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অথচ উষ্ণায়নের ফলে বর্তমানে এ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। অত্যধিক বরফ গলনের কারণে নদী–নালা একসঙ্গে এত পানি ধারণ করতে না পারায় দেখা দিচ্ছে অকাল বন্যা, বিঘ্নিত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন, সৃষ্টি হচ্ছে খাদ্য সংকট। গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর ক্রম উষ্ণায়মানতার কারণে সাগর থেকে জলীয় বাষ্প উঠে এলেও তা হিমবাহ গাত্রে জমাট না বেঁধে বৃষ্টি আকারে ঝরে পড়ছে। তাই শীত–বসন্তে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। এ জন্য দেখা যাচ্ছে বর্ষায় খরা আর শীতে অকাল বৃষ্টি–বন্যা। অর্থাৎ প্রয়োজনের সময় পানি নেই, অথচ অপ্রয়োজনে অপ্রত্যাশিত পানি। উভয় অবস্থাতে বিঘ্নিত হচ্ছে কৃষিকাজ, বাড়ছে খাদ্য সংকট।
এক সময় বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হতো। এর ফলে নদীনালা–খালবিল ভরাট থাকতো। পানির অভাবে কৃষিকাজ বিঘ্নিত হতো না। কিন্তু উষ্ণায়নের প্রভাবে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত খুবই কম হচ্ছে। এদিকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত বেশিরভাগ নদীর উজান দিকে বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক গতিপথকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা তাদের দেশের জন্য পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়ার ফলে বাংলাদেশ তার পানির ন্যায্য পাওনা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে কৃষিকাজে ব্যাপক অসুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে–মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, মৎস্য চাষ ব্যাহত হচ্ছে, নানারকম রোগের সৃষ্টি হচ্ছে, গাছপালা মরে যাচ্ছে। জাতীয় এ সমস্যার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি কৃত্রিম নদী ও জলাশয় খনন করে পানি ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে–যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করা হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যেক সরকার কৃষিকে গুরুত্বের সাথে দেখে কিন্তু সরকারের পর্যাপ্ত লিডিং এর অভাবে কৃষির উন্নতি হয় না। আমাদের দেশের মাটি উর্বর, জাপানের মত কৃষি নির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাদের মত কৃষি থেকে সুফল পাই নি। সরকার বাজেট ঘোষণাতে কৃষি খাতকে উচ্চতর দৃষ্টি থেকে দেখলেও বাজেটের যে অর্থ তা থেকে কৃষক কতটুকু সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে তা অজানাই থেকে যায়। এমন কি অধিক কৃষক জানেনও না বাজেট থেকে তাদের কি লাভ বা সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তার কারণ একটাই অব্যবস্থাপনা। আধুনিক কৃষিনীতির মাধমে কৃষির উন্নতি না করলে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। শিক্ষিত ব্যক্তিদের কৃষিখাতের উন্নতির জন্য এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও ওষুধ দ্বারা কৃষি খাতকে এগিয়ে নিতে হবে, তার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকেই। দেশের স্বার্থে, কৃষকের স্বার্থে কৃষিখাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।