কৃষকের স্বার্থে বন্যাকবলিত অঞ্চলের মাটি পরীক্ষা দরকার

ড. মোঃ আবুল কাসেম | বৃহস্পতিবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ

গত মাসের বন্যা ছিল একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই ভয়াবহ বন্যায় দেশের ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুর জেলার ৬৫ উপজেলা ও ৪৯৫টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছে দেশের সকল স্তরের মানুষ। খোলা হয়েছিল ৩ হাজার ১৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র যেখানে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৯ বন্যাদুর্গত মানুষ এবং ১৭ হাজার ৮৪৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এই বন্যায় ১১টি জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৬ লাখ মানুষ এবং প্রাণ হারিয়েছেন ৬৭ জন এর মধ্যে শুধু ফেনীতেই ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিম আহমেদ পলাশ।

চলমান বন্যায় চট্টগ্রাম কৃষি অঞ্চলে প্রায় ১ হাজার ৬৫১ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ৭ হাজার ৫১৫ জন। সংশ্লিষ্টদের মতে বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী জেলা।

গত ২২ আগস্ট কৃষি মন্ত্রণালয় বন্যাদুর্গত এলাকায় কৃষি খাতে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ দ্রুত নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের জন্য ১২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, যার মধ্যে বন্যা কবলিত এলাকার মৃত্তিকা জরিপ ও মৃত্তিকা নমুনা পরীক্ষাটা বিবেচনায় আনলে ভালো হতো। কারণ বন্যার পরে মৃত্তিকা বা মাটির অবস্থা জানার জন্য মৃত্তিকা পরীক্ষা জরুরি, যার উপর শস্য নির্বাচন ও সার প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ করে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ এই বন্যার মত ১৯৩১ সালের মধ্য চীনের বন্যাটাও ছিল ভয়ংকর। ঐ বন্যায় চীনের কয়েক মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। পরবর্তী পরিণতি ছিল বিধ্বংসী; আমাশয় এবং কলেরার মতো মারাত্মক জলবাহিত রোগ এবং যারা বেঁচে ছিল তারাও অনাহারের হুমকির মুখোমুখি হয়েছিল কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশের সকল স্তরের মানুষের সহযোগিতা নিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর কারণে চীনের মত ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে নাই।

যেখানে বন্যা এতো বড় বিপদ ডেকে আনে, তারা আবার অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি, যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং জৈব উপাদান আশেপাশের জমিতে পরিবহন করে। আবার উজানের পানি নিচে নামার সময় লবণকে গলিয়ে সমুদ্রের পানিতে মিশিয়ে দেয়, তাতে উপকূলীয় অঞ্চলের জমিতে লবণাক্ততাও কমে আসে। তাছাড়া বন্যার ঘোলা পানি পলি থিতিয়ে পড়ে যা জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ায় এবং সৃষ্টি করে অধিক ফলনের সম্ভাবনা। কিন্তু এবারের বন্যার পানির গ্রোতের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, নদী দিয়ে প্রবাহিত না হয়ে রাস্তাঘাট, কৃষি জমি ও বাড়িঘরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ছোট ছোট নালা, ডোবা ও পুকুর ভরাট হয়ে গিয়েছে, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে জমির উপরের স্তরের মাটিও সরে গিয়েছে। প্রথম আলোর তথ্যেও (১০ সেপ্টেম্বর) ফেনী জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজী এলাকার প্রায় ২৫০ হেক্টর জমি কয়েক ফুট বালুতে ঢেকে যাওয়া এবং নদীর আশপাশে কিছু কিছু জমিতে বালুর স্তূপ জমাট হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক কৃষক বলেছেন বালু জমার কারণে তাদের নিচু জমি উঁচু জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের কারণে আবাদি জমির ভূমি শ্রেণি (উচু, মাঝারি উচু, মাঝারি নিচু, নিচু ও অতি নিচু), মৃত্তিকার বুনটে (বালি, পলি ও কাদা কণার আনুপাতিক পরিমাণ) জৈব পদার্থ ও অম্লত্বের তারতম্য দেখা দিবে, তা ধারণা করা যায়। এই অবস্থায় কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর শস্য নির্বাচন ও সার সুপারিশের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হবেন।

পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বন্যা কবলিত এলাকার মাঠ জরিপ ও মৃত্তিকা পরীক্ষা করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউ অতি দ্রুত দুর্যোগপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ করে তাদের গবেষণাগারে (মৃত্তিকার বুনট, পিএইচ, অর্গানিক কার্বন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান) পরিমাপ করতে পারেন। এই কাজটি স্বল্প সময়ে করার সক্ষমতা এই প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকার মৃত্তিকা নমুনার ডাটা গুলো তাদের উপজেলা মৃত্তিকা ও ভূমি সম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকার (বিশেষ করে ১৯৯৯ সালের পরের) ডাটার সাথে তুলনা করে তাদের পরামর্শ ও তথ্য কৃষি মন্ত্রণালয়কে সরবরাহ করতে পারেন। যার উপর ভিত্তি করে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর শস্য নির্বাচন এবং সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক ও জৈব সার প্রয়োগের সুপারিশ করতে পারবেন। তাতে কৃষক উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতরুণদের স্বপ্নের সাথে এগিয়ে চলার সময় এখন
পরবর্তী নিবন্ধঐতিহ্যের চট্টগ্রামে ঐতিহ্যের খাবার