১৯৯০ সালের কথা। আমি নবাব সিরাজুদ্দৌলা রোডে একটি মেস কোয়ার্টারে থাকতাম। ২ কক্ষ বিশিষ্ট বাসায় ৬ জন চাকুরিজীবীর ছিল বসবাস। প্রতি মাসে এক একজন মেস ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পেতেন। আমার দায়িত্ব পালন কালীন দেখা দিল বাবুর্চির সংকট। সেই ক্রান্তিকালে একদিন এক তরুণ বাসায় এসে বাবুর্চি কাজে তাকে নিয়োগের প্রস্তাব দিল।
নাম মোহাম্মদ আবদুস সোবহান। গ্রামের বাড়ি লাঙ্গলকোট। পিতা বাক প্রতিবন্ধী। সংসারে মা, ৩ ভাই ও ২ বোন। জীবিকা অন্বেষণে সোবহান চট্টগ্রাম এসেছে। ছেলেটির কথাবার্তায় মায়া হলো। অন্যান্য মেস কলিগদের সাথে আলাপ করে তাকে বাবুর্চি হিসেবে নিয়োগ দিলাম। মাসিক বেতন ৫০০ টাকা। কাজকর্মে তার পারদর্শিতায় সকলেই সন্তুষ্ট। বিশ্বাস ও আস্থার কোনো ঘাটতি পরিলক্ষিত হলো না। এক বছর না যেতেই জমিদারের প্রয়োজনে বাসা ছেড়ে দিতে হচ্ছে বিধায় মেসটি গেলো ভেঙ্গে। সোবহানকে বললাম, তুমি আপাতত আমাদের গ্রামের বাড়িতে কাজ কর। কথা দিলাম, এক বছর পর তোমাকে আমাদের পদ্মা অয়েল কোম্পানির হেড অফিস স্টাফ কেন্টিনে চাকুরি দিব। ১৯৯২ সালে সোবহান কেন্টিনে জয়েন করে। মাসিক বেতন ৯৫০ টাকা। থাকা-খাওয়া ফ্রী। সাপ্তাহিক ২ দিন ছুটি।
১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে কোম্পানি আমাকে শ্রীমঙ্গল ডিপোর ইনচার্জ করে পাঠালেন শ্রীমঙ্গল। একই বছরের শেষের দিকে পদ্মা অয়েল কোম্পানি কীটনাশক ব্যবসা সমপ্রসারণের লক্ষ্যে শ্রীমঙ্গলে নতুন অফিস খুলল। মরহুম খোন্দকার সরওয়ার উল আলম সাহেব এলেন দায়িত্বভার নিয়ে। তাঁর নতুন পদবী ‘ম্যানেজার প্লান্টেশন ক্রপস’।
সরওয়ার সাহেব নিয়মিত আমার ডিপো অফিসে আসতেন। একদিন বললেন, ওনার অফিসে একজন কোম্পানির চুক্তি ভিত্তিক নিরাপত্তা প্রহরী নিবেন। আপনার পরিচিত কেউ থাকলে খবর দিন। আমি সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম। একদিন পরেই সোবহান চট্টগ্রাম থেকে শ্রীমঙ্গলে পৌঁছে গেলো। সরওয়ার সাহেব নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কাগজপত্র হেড অফিস পাঠিয়ে দিলেন। চুক্তি ভিত্তিক নিরাপত্তা গার্ড হিসেবে সোবহান যথারীতি কাজে যোগ দিল। মাসিক বেতন ২৪৫০ টাকা। ওভারটাইম করলে আরও কিছু বাড়তি পাবে। আলহামদুলিল্লাহ। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১২ সালের অক্টোবরে কোম্পানিতে সোবহানের চাকুরি স্থায়ী হলো। বর্তমানে আল্লাহর রহমতে সচ্ছল বলা যায়। বাক প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ বাবা এবং বৃদ্ধা মায়ের কষ্টের জীবনে সোবহান কিছুটা হলেও মুখে হাসি ফুটিয়েছে। ৪ কন্যা সন্তানের জনক সোবহানের ৩ মেয়ে বিবাহিতা। মেজ মেয়ে জামাইসহ সৌদি আরবে। সোবহান বর্তমানে পদ্মা অয়েল কোম্পানির সদরঘাটস্থ হেড অফিসে কর্মরত কয়েকদিন পর পর ফোনে কুশলাদি জানতে চাওয়া ছাড়াও মাসে অন্তত ২ বার আমাকে দেখতে আসে। রুটিন মাফিক গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ডিউটি শেষে সন্ধ্যায় বাসায় এসেছিল আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা সোবহান। সত্যি, মোহাম্মদ আবদুস সোবহান আমার দেখা একজন কৃতজ্ঞ মানুষের নাম।