কোনো রিকশা বা টেক্সি চালককে বললেই পৌঁছে দিবে নগরের সিরাজউদ্দৌলা রোড মাছুয়াঝর্ণা কুয়ার পাড়ে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে হাজার খুঁজলেও দেখা যাবে না কাঙ্ক্ষিত সেই কুয়া। অথচ একসময় এখানে কুয়া ছিল। কয়েক দশক আগেও স্থানীয়রা পান করতেন সেই কুয়ার পানি। শুনে কল্পগল্প মনে হলেও এটাই বাস্তবতা।
শুধু মাছুয়াঝর্ণার কুয়া নয়; কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে শহরের অন্যান্য কুয়াগুলোও। অথচ একসময় এসব কুয়ায় ছিল নগরবাসীর সুপেয় পানির চাহিদা মেটানোর অন্যতম উৎস। অবশ্য এখনো বেশ কয়েকটি কুয়ার চিহ্ন আছে। সাধারণ লোকজন মনে করেন, ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এসব কুয়া সংরক্ষণ করা উচিত। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান তারা। নগরের প্রবীণ লোকজনের সঙ্গে আলাপকালে এবং বিভিন্ন নথিপত্র পর্যালোচনায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, একসময় শহরে প্রায় প্রতিটি বাড়ি ও পাড়া-মহল্লায় কুয়া ছিল। এর মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বা পাড়া-মহাল্লায় ছিল প্রায় শতাধিক কুয়া। যেগুলো সবার জন্য ছিল উন্মুক্ত। তৃষ্ণার্ত পথচারী কুয়ার স্বচ্ছ জল পান করে ভুলতেন পথের ক্লান্তি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, এমনকি আশির দশকেও বেশিরভাগ কুয়া ব্যবহার উপযোগী ছিল। ৯০ এর দশক থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসে কুয়াগুলো। বিশেষ করে যখন বাসা-বাড়িতে টিউবওয়েল বসানো শুরু হয় তখন থেকে।
পরবর্তীতে গভীর নলকূপ বসানো শুরু হলে পনির স্তর কমতে থাকায় কুয়াগুলো একেবারেই বিলীন হয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরের জামালাখানে দুটি কুয়া ছিল। এরমধ্যে লিচুবাগানে একটি এবং জামালখান বাইলেনের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশে ছিল অপরটি। লিচুবাগানের কুয়ার পাড়টি এখনো আছে। এখানে আশেপাশে গড়ে উঠা বিভিন্ন খাবারের দোকানগুলো থেকে উচ্ছিস্ট ও ময়লা-আর্বজনা ফেলতে ফেলতে ভরাট করা হয়েছে পুরো কুয়াটি।
প্রায় ৬০ বছর আগে গড়ে ওঠে পলোগ্রাউন্ড রেলওয়ে কলোনি। তখন সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য খনন করা হয় একটি কুয়া। কয়েকবছর আগেও কুয়াটি ব্যবহার উপযোগী ছিল। কিন্তু গতকাল পরিদর্শনে দেখা গেছে, কুয়াটি ময়লা-আর্বজনায় ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে জন্ম নিয়েছে পেঁপে গাছ ও অন্যান্য গুল্ম-লতা। স্থানীয় বাসিন্দা মারুফ হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, কয়েক বছর আগেও পানি পাওয়া যেতো কুয়া থেকে। বৃষ্টির পানির সাথে উপরের কাঁদামাটি পড়তে পড়তে সেটি ভরাট হয়ে গেছে। ঐতিহ্য হিসেবে এটাকে সংরক্ষণ করা দরকার।
শহরের ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য কুয়াগুলোর মধ্যে ছয়-সাত বছর আগে অস্তিত্ব হারিয়েছে হাজারীগলির বামপাশে কেসি দে রোডের মুখের কুয়াটি। ঘাটফরহাদবেগ এলাকায় একটি কুয়া ২০০৪ সালেও দেখেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড আফিসের পাশের কুয়টি একদশক আগেও দেখা গেছে। এছাড়া কোতোয়ালী থানার পেছনে সতীশ লেইনের মুখে এবং পাথরঘাটা জে এম সেন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশেও একটি কুয়া ছিল। এসব কুয়ায় শত শত লোক প্রতিদিন গোসল করতেন বলে স্মৃতিচারণ করেছেন সত্তোর্ধ আবদুল গফুর।
নগরের কুয়াগুলো সংরক্ষণ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, নিরাপদ পানির অন্যতম উৎস ছিল শহরের কুয়াগুলোর। এখন তো সেই কুয়া নেই। জামালখানের কুয়া নিয়ে আমারও স্মৃতিও আছে। ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে কুয়াগুরো সংরক্ষণে উদ্যোগ নিব। আগামী রোববার অফিসে গিয়ে আদেশ জারি করবো। শহরে কী পরিমাণ কুয়া ছিল তার তথ্য সংগ্রহ করবো। এবং এওখনো যেসব কুয়ার চিহ্ন আছে সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিব।
এদিকে নগরের বিভিন্ন কুয়াগুলো হারিয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিষ্ঠার পরও কুয়া ছিল সুপেয় পানির প্রধান উৎস। একটা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি পানি সরবরাহে নির্ভর হয় ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর। অর্থাৎ গভীর নলকূপ বসানোর দিকে মনোযোগী হয়। এছাড়া সাধারণ মানুষও ভূগর্ভস্থ পানির দিকে ঝুঁকতে থাকে। কুয়ার জায়গা দখলে নেয় নলকূপ। ভূ-গর্ভস্ত পানি ব্যবহারের ফলে ধীরে ধীরে উপরিভাগের পানির স্তর নিচে নামতে থাকে। এতে প্রভাব পড়ে কুয়াগুলোতেও। ২০১৩ সালে নগরীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ভূ-গর্ভস্থ পানি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা করে চট্টগ্রাম ওয়াসার একটি বিশেষজ্ঞ দল। এর মধ্যে কালুরঘাট, মোহরা, চান্দগাঁও ও বাকলিয়া এলাকাকে নিয়ে একটি ব্লক এবং শহরের অন্যান্য এলাকাকে নিয়ে আরেকটি ব্লক করা হয়। ওই গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, গভীর নলকূপের জন্য পানি পাওয়া ৩০০ ফুটের মধ্যে। ওসব এলাকায় বছরে পানির স্তর গড়ে ২০ ফুট করে নিচে নামছে।