‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’, মুহাম্মদ কাইউম পরিচালিত, বাংলা ভাষায় নির্মিত একটি সত্য চলচ্চিত্র। ‘সত্য’ কোন অর্থে? ভান ও ছলনামুক্ত শিল্পসৃজনের অর্থে। ক্ষুধাকে ক্ষুধা, ব্যথাকে ব্যথা এবং প্রেমকে প্রেম বলার অর্থে। আমরা ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র’ বলে একটি শব্দযুগলের সাথে পরিচিত। কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাধীন অর্থে আমরা যে মুক্ততা বুঝি, সেদিক থেকে এমন চলচ্চিত্র বিরল। কোনো ব্যাংকের দ্বারস্থ না হয়ে, সরকারি অনুদানের অপেক্ষায় না থেকে, বহুজাতিকের কাছে না গিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে একটি অবাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণ আনন্দের ঘটনা নিশ্চয়ই, আশাবাদেরও। অন্তত আমরা যারা চাই পুঁজির অধীনতাময় পরিস্থিতি থেকে শিল্প মুক্তি পাক। পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল- আমরা পড়েছি ছেলেবেলায়, ভূগোলে। এই চলচ্চিত্রের জলের ভাগটা আরও বেশি, অন্তরে ও বাইরে, পরিবেশে ও প্রতিবেশে, শিল্পের নন্দনে ও সত্যে। জল এখানে কখনো দৃষ্টির প্রসন্ন আশ্রয়, কখনো বিপন্ন অন্ধকার। গল্পটি হাওর অঞ্চলের। এমন এক অঞ্চল যেখানে ধানের জমি ডুবে যায় পাহাড়ি ঢলে, বন্যায়। দিগন্তবিস্তীর্ণ ধানের শীষ পুষ্ট হতে দেখার জন্য পুরাণবিশ্বাসে নিয়োগ করা হয় দেবীকে, তিনি উজ্জ্বল উদ্ধার, তিনি পরমা প্রকৃতি মা, সব দেখে রাখবেন। এই ধান সারা বছরের খাদ্যের একমাত্র উৎস। হাওর অঞ্চলে আছে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকা অগুনতি প্রায় নিরন্ন মানুষ, আছে ঋণদাতার ক্যাশবাক্স, বীজধান কিনে একটা অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্যে দরকার হয়ে পড়ে ঋণ। যদি ঘরে ধান আসে, প্রাণান্ত কষ্ট হলেও ঋণ শোধ করে ফেলা যায়। কিন্তু ধান আসবে কী না- এই প্রশ্নটাই মৌলিক।
হাওর অঞ্চলে কাজ করতে আসা মাতৃহারা এক যুবক, সুলতান- চরিত্রটির নামে বুঝি তার গায়ে লেগে আছে চলে যাওয়া মায়ের অযুত মমতা। মা ছাড়া সংসারে ভাত জোটে না, তাই নতুন এই পরিবারে কোনোমতে ক্ষুণ্নিবৃত্তির প্রতিশ্রুতিতে লেগে পড়ে কাজে। প্রথম রাতে ভাত খেতে বসে, সাদা ভাতের সামনে সে স্তব্ধ কেননা মা চলে যাওয়ার পর এতো যত্ন করে ভাত কেউ দেয়নি। তখন ছোট্ট মেয়ে রুকু নিজের ভাগ থেকে, নিজের ছোটো হাতের মুঠিতে তুলে দেয় এক মুঠো ভাত, আমরা বুঝি কন্যারা জন্মসূত্রেই মাতৃমূর্তি-প্রকৃতিপ্রতিম। সুলতান মায়াহীন সংসার থেকে ছিটকে এসে জড়িয়ে পড়ে মায়ার বাঁধনে। রুকুর বাবা মারা গেছেন হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে। এখন রুকু, তার মা আর তার অতিবৃদ্ধ দাদা- এই তিনের সংসার। আছে সংবেদী প্রতিবেশী। আছে গ্রামের মানুষেরা। সবার উপরে আছে পারস্পরিক আত্মীয়তাবোধ, যা আমরা প্রায় হারিয়ে ফেলেছি।
হাওর অঞ্চলের ভূগোল, প্রকৃতির সাথে প্রতিদিন দ্বৈরথ চলে মানুষগুলোর। চলচ্চিত্রের পরিচালক দক্ষ শল্য চিকিৎসকের মতো ব্যবচ্ছেদ করে দেখান জল অধ্যুষিত একটি অঞ্চলের জনজীবনের সাথে যুক্ত প্রতিটি বিষয়। একটি অঞ্চলকে কোনোরকম ছদ্মপ্রগতিশীলতার আড়াল না নিয়েই আমাদের চোখের আর মনের সামনে উন্মুক্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জল জীবন রক্ষা করে, আবার বিধ্বস্ত-ও করে। পৃথিবীর প্রতিটি সাধারণ মানুষের মতো হাওরের মানুষও মূলত ভাসমান, শরণার্থী। ছুটে চলা-ই নিয়তিনির্দিষ্ট। সুলতান রুকুর ছোটো বোনের মায়ায় পড়ে কোমরে পরা ঘুন্টি কিনে আনে। শিশুটি যখন টলমল পায়ে হাঁটে, সারা পর্দা জুড়ে শিশু আনন্দের শব্দের প্রতিধ্বনি ঘটে। হাওরে মাঝে মাঝে আনন্দ ঘটে, যেমন- বিয়ে। যেমন- দূর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসে নৌকা, বিয়ের বরকনেকে নিয়ে যায় সুসজ্জিত জলযান। সুলতান আর রুকুর মায়ের বিয়ে ঘটে, খানিকটা প্রয়োজন আর অনেকটাই মায়া শীর্ষক অভূতপূর্ব অনুভূতির টানে। বিয়ের দৃশ্যে ব্যবহৃত গান কাউকে কাউকে মনে করিয়ে দিতে পারে ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রের সঙ্গীত প্রয়োগের অবাণিজ্যিক প্রথা বা প্রথাবিরোধীতাটি। তারপর একদিন আসে গভীর দুঃখের দিন। দূর থেকে আসা লঞ্চে বিয়ের বরকনে দেখতে সারা গ্রাম ভেঙে পড়ে কেন না তাদের জন্যে বিশ্ববিধাতা অতিরিক্ত কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা রাখেননি। রুকুর মা সবার সাথে দেখতে যায় উজ্জ্বল ভাসমান যাত্রীদের। সেই ফাঁকে ছোটো শিশুটি জলের গর্ভে হারিয়ে যায়। এই শূন্যতা অতুল। রিক্ত সে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, পরিচালক কি এমন কোনো বার্তা দিতে চাইছেন যে বাইরের অনেক আয়োজনের দিকে চোখ ফেরাতে গিয়ে আমরা নিজের কাছে ফেরা ভুলছি এবং নিজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চয় হারাচ্ছি!
কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া চলচ্চিত্রে আছেন একজন প্রাজ্ঞ দার্শনিক। তিনি জানেন, আকাশের কোনো সীমানা নেই তাই জমির সীমানাও মানেন না। ধান অমরলতা- বলেছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এক সাক্ষাৎকারে। ধান জনপদের মানুষের জান। রুকুর দাদা তাই মনে করেন, ধান গাছের উপর ছাতা ধরলে ধানের অসম্মান ঘটে। আর যেহেতু ধান চৈত্র মাসের রোদেও সহজ হয়ে থাকতে পারে, মানুষ কেন পারবে না! এই একটা বাক্যে হাওরের মানুষদের জীবনীশক্তির সারসত্য আমাদের সামনে উপস্থিত হয়।
কাহিনিচিত্রকে কখনো কখনো তথ্যচিত্র মনে হতে পারে। মনে হতে পারে,অনেক তথ্য গুঁজে দিচ্ছেন। এখানে আমরা আবারও শ্রীযুক্ত বাবু ঋত্বিক ঘটকের শরণ নিতে পারি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন- ‘পরিস্থিতির সত্য বোঝাতে গেলে অনেক সময় বার বার আঘাত করে বলবার কথা বলে নিতে হয়।’ আমার মনে হয়, একজন নির্মাতা যখন কিছু আঁকাড়া সত্য তুলে ধরতে চান, রাজনৈতিকভাবে সৎ হতে চান তখন তিনি তাঁর বক্তব্যটুকু তাঁর নির্মাণেই তো বলবেন। স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলে সেইজন্যে সংবাদমাধ্যম যায় আর হাওরের মানুষেরা বলেন, এখন এসব বলে কি লাভ! সংবাদমাধ্যমের আগমন দেখানো হয়েছে কিছু সংবাদ কর্তিকা আর ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকারে। কিন্তু সাংবাদিক উহ্য কেননা এখানে ক্যামেরাই তাঁর ভূমিকা পালন করছে। সুকান্ত মজুমদারের শব্দ পরিকল্পনা, সাত্যকি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনা, মাজাহারুল রাজুর চিত্রগ্রহণ এবং অর্ঘ্যকমল মিত্রের সম্পাদনা পরিচালককে যথোপযুক্ত সঙ্গত দিয়েছে। জয়িতা মহলানবিশ, উজ্জ্বল কবির হিমু, সুমি ইসলাম, সামিয়া আকতার বৃষ্টি, বাদল শহীদ, মাহমুদ আলম, আবুল কালাম আজাদ- এই কুশীলব তাঁদের অভিনীত চরিত্রের প্রতি সুবিচার করবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। বার বার অকুস্থলে গিয়ে ঋতুবৈচিত্র্য, পরিবেশের বিস্তারের পরিবর্তন ধারণের যে শ্রম তাতে কেউ কার্পণ্য করেননি। কুড়া পক্ষীর অনুষঙ্গে মানুষের সাথে প্রকৃতির যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্রায়ণ চলচ্চিত্রটি। একেবারে শেষে যে লাতিন প্রবাদ সেটাই মনে হয় যাবতীয় শিল্পের আসল কথা- মানুষ ফুঁসে উঠবে না মরে যাবে?