অপরূপ রূপের ঋতু হেমন্ত। কার্তিক এবং অগ্রহায়ণ এই দুই মাস মিলে হেমন্ত ঋতু। অগ্রহায়ণ মাস বাংলার প্রধান ফসল আমন ধান ঘরে তোলার মাস। কবিগুরু যথার্থই বলেছেন,‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে কি দেখেছি/ আমি কি দেখেছি মধুর হাসি সোনার বাংলা—’। রূপে, রসে, গন্ধে অনন্য এক ঋতু অগ্রহায়ণ। কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবনে এই মাসে সোনালী ধান গোলায় ভরে কৃষকের মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি। কবিগুরু অগ্রহায়ণ মাসের বর্ণনায় বাংলার মাঠে ভরা সোনালি ধানের অর্থাৎ পাকা ধানের মধুর হাসির কথা বলেছেন। তাইতো তিনি এই ঋতুকে ‘হেমন্তলক্ষ্মী’ উপাধি দিয়েছেন। কারণ কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষকদের সারা বছরের পরিশ্রমের ফল পাকা সোনালী ধান এই সময়ে কৃষকদের উঠোনে উঠোনে শোভা পায়।
অগ্রহায়ণের পরে আসে পৌষ। অগ্রহায়ণ পৌষ মানেই আমরা বুঝতাম ডিসেম্বর মাস। অন্যরকম আনন্দ। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। স্কুল বন্ধ, পড়াশোনা নেই, প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়াশোনার চাপ নেই। সারাদিন টই টই করে বন্ধুদের সাথে পাড়া বেড়ানো আর ইচ্ছেমত গল্পের বই পড়া। গ্রামের আনাচে কানাচে কার বাড়িতে তেতুল পেকে উঠেছে, কার বাড়িতে চালতা হলুদ হয়ে এসেছে আবার কার উঠোনে জলপাই পাতার ফাঁকে ফাঁকে সবুজ থোকা থোকা ঝুলছে, তা আমাদের চেয়ে বেশি আর কে জানে! অনেকের আবার ঘরের লাগোয়া জমিতে লম্বা লম্বা হলুদসবুজে মেশানো আঁখ সারিসারি দাঁড়িয়ে আছে। চিকন চিকন পাতার ফাঁকে ফাঁকে আমলকিগুলোও এই সময় পেকে যায়। কবিগুরুর ভাষায়– ‘শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন/ আমলকির এই ডালে ডালে—‘। গ্রামে সবাই সবার সাথে মিলেমিশে থাকার একটা রেওয়াজ ছিল। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আমরা দলবেঁধে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়াতাম, আর কোঁচা ভরে হরেক রকম সুস্বাদু গাছের ফল নিয়ে আসতাম। এসময় বাড়িতে উঠোনময় সারিসারি সোনালী ধানের স্তুপ। উঠোনের কোথাও এটুকু ফাঁকা জায়গা থাকত না। চারিদিকে পাকা সোনালী ধানের গন্ধে মৌ মৌ করত। বাড়ির সবাইতো আছেই আরও অতিরিক্ত ৪/৫ জন লোক নিয়মিত কাজ করত। ঘরে তখন উৎসব উৎসব ভাব। প্রায় প্রতিদিনই নতুন চালের বিভিন্ন শীতকালীন পিঠা (ভাপা, চিতই, পাটিসাপটা আরও কত কী), পায়েস রান্না হতো। সকাল থেকেই বাড়ির সবার কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত, এই পাকা ধানকে ঘিরেই। কেউ ধান শুকাচ্ছে, কেউ খড় শুকাচ্ছে। সারাবছরের মানুষের প্রধান খাদ্য এই ধান ভালো করে শুকিয়ে গোলায় তোলা হচ্ছে। শুকনা খড় সারাবছরের গরুর শুকনা খাবার, তাই এই খড়ও বিশেষ যত্ন সহকারে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে। পুরুষ কৃষিশ্রমিক বড় কাঠের গুড়িতে হাত দিয়ে পিঠিয়ে ধান মাড়াই, মহিলারা পা দিয়ে বিশেষ কৌশলে ধান মাড়াই করতো। পুরুষেরা দৈনিক বেতনের বিনিময়ে কাজ করলেও মহিলাদের হিসেব আলাদা। তারা এক আড়ি ধান মাড়াই করলে এক সের ধান পেত। দুপুরের পরপর রোদ একটু পরে আসলে চার পাঁচটা গরু লম্বা করে একটা বীমের (চট্টগ্রামের ভাষায় মইয়া বলত) সাথে বেঁধে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধান মাড়াই করা হত। মাঝে মাঝে বাড়ির ছোটদের দায়িত্ব দেওয়া হত একটা পাতলা বেত হাতে নিয়ে ‘বৈল বৈল’ শব্দে গরুগুলোকে ঘুরানো।
কী অপূর্ব সেই সময়গুলো! এভাবেই প্রায় এক মাসেরও বেশি দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে সব ধান যেদিন গোলায় তোলা হয়ে যেত, সেদিন ওই মইয়াটা তুলে রাখা হত, বিশেষ যত্ন সহকারে, যা আগামী বছর কাজে লাগবে। সেদিন বাড়িতে উৎসব মুখর পরিবেশে বিভিন্ন রকমের নতুন চালের পিঠাপুলি, পায়েস রান্না হত। এতদিন যারা বাড়িতে কাজ করেছে, তাদের পিঠার আমন্ত্রণ আর দুপুরে ভাতের নিমন্ত্রণ করতো। বাড়ির আশেপাশে প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে পিঠা পাঠানো হত। বাড়িতে ওই দিনটাতেই নবান্ন উৎসবে মেতে উঠত ছোট–বড় সবাই।
সন্ধ্যায় আমাদের আনন্দের নতুন আরেক ধাপ শুরু হয়ে যেত। ধান মাড়াই করা খড়ের স্তুপের মধ্যে লুকোচুরি খেলা। আমাদের উঠোনের চারিদিকে পাকা বাউন্ডারি ওয়াল দেয়া বাড়িতে নিরাপদে লুকোচুরি খেলা করতে প্রতিবেশী ছোট বড় সব বন্ধু চলে আসত। বিদ্যুতের আলো আর চাঁদের আলো মিলিয়ে অন্য এক মাত্রা যোগ হত পুরো উঠোনে। মাঝে মাঝে জোনাকি দেখতে ও ধরতে রাস্তায় চলে যেতাম।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাবা আমাদের জন্য শহর থেকে নতুন বই কিনে নিয়ে আসতেন। নতুন বই হাতে নিয়ে উল্লাস আর উচ্ছ্বাসে শুঁকে শুঁকে দেখতাম। কী মধুর নতুন বইয়ের ঘ্রাণ! তারপর শুরু হয়ে যেত সুর করে বাংলা বইয়ের কবিতা মুখস্থ করা।
অসংখ্য সুন্দর সুন্দর কবিতা। সুউচ্চস্বরে পড়তাম, প্রথমত, রান্নাঘরে মা’র কানে অবশ্যই উচ্চারণ পৌঁছাতে হবে, কারণ উচ্চারণ ভুল অমার্জণীয় অপরাধ। দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশী বন্ধুদের জানান দেওয়া যে, সবার আগে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ আমার কাছেই পৌঁছেছে।
শহর থেকে বাবার আগমন ছিল আমাদের কাছে স্বর্গসুখের মত। বিভিন্ন লোভনীয় ফল আর সুস্বাদু খাবার নিয়ে বাবা আসত প্রতি ১৫ অথবা ২০ দিন পরপর। মাসের প্রথম দিকে উত্তরের খুব ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু না হলেও শীত খুব একটা কম ছিল না। ঘরে নিয়মিত পরার জন্য আরামদায়ক জুতা আর সুন্দর সুন্দর সোয়েটার নিয়ে আসতেন বাবা। কারণ আগের বছরের সোয়েটার ছোট হয়ে যেত। এই নিয়ে মায়ের সাথে আমাদের এক তরফা হয়ে যেত। কারণ আমরা মনে করতাম, কাঠের আলমারীতে রেখে দিয়েছে বলে সেগুলো ছোট হয়ে গেছে। এরকম অসংখ্য সুন্দর সুন্দর স্মৃতি হৃদয়ের মণিকোঠায় জমা হয়ে আছে।
কুয়াশা ঢাকা ভোরে চারিদিক অন্ধকার হয়ে যেত। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মুখ ধুয়ে ফুলের সাজি নিয়ে কার আগে কে বের হবে সেটা নিয়ে অলিখিত একটা প্রতিযোগিতা ছিল। সবার আগে সব ফুল আমার চাই–ই। শিশির ভেজা ঘাসের উপর শিউলি ফুলগুলো মুক্তোর মত ঝলঝল করত। সেই ফুল কুড়াতে গেলে কুয়াশায় পা ভিজে যেত। বাড়ির চারিদিকে আরও ছিল হরেক রকমের ফুল গাছ। ভোরের আলো পুরোপুরি না ফোটার আগেই সাজি ভরিয়ে ফেলতাম শিউলি, নীল অপরাজিতা, লাল জবা, সাদা বকফুল আর বিভিন্ন কালারের কলাই ফুলে। বাড়ির কাশি গাঁদা ফুলগুলো রেখে দেওয়া হত গাছে, বাড়ির চারপাশ সৌন্দর্য রক্ষা আর বেশী শীত পড়লে যখন অন্য ফুল কম ফুটে , তখন এই ফুল পূজার কাজে ব্যবহার করার জন্য।
খুব সম্ভবত তখন পৌষের দশ তারিখে (সঠিক তারিখটা আমার মনে নেই) চট্টগ্রামের বলুয়ার দিঘিতে নামকরা বড় মহৌৎসব হত। ঠাকুরমা প্রতিবছর আমাদেরকে নিয়ে ওই উৎসবে অংশগ্রহণ করতেন। সে আরেক আনন্দদায়ক ভ্রমণ! সন্ধ্যায় ভাত খেয়ে আমরা রিঙা করে লঞ্চ ঘাটে যেতাম। সারারাত লঞ্চটা আস্তে আস্তে চলত, খুব ভোরে ঘন কুয়াশায় যখন চারিদিক অন্ধকার তখন আমরা ঘুম চোখে অনেক দূর থেকে তারার মত বিদ্যুতের লাইট দেখতে পেতাম। মন তখন আনন্দে নেচে উঠত, বুঝতে পারতাম, শহরের খুব কাছেই আমরা। একটু পর লঞ্চ থেকে নামলেই বুকে জড়িয়ে ধরবে আমার বাবা। আর বাসায় গেলে ঘুম থেকে ঠেলে তুলবো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দাদাদের।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি,
বোয়ালখালী হাজী মো: নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।