কুমিল্লা ও ঢাকায় পাইপলাইনে তেল যাবে শীঘ্রই

চট্টগ্রাম-ঢাকা জ্বালানি তেল পরিবহন প্রকল্প কমিশনিং শুরু

হাসান আকবর | সোমবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আড়াই হাজার কোটির বেশি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা এবং ঢাকা অঞ্চলে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ প্রকল্প একেবারে শেষ পর্যায়ে। শীঘ্রই চট্টগ্রামের ডিপো থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল যাবে কুমিল্লা ও ঢাকা অঞ্চলে। দেশের প্রথম এই অত্যাধুনিক এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি সমৃদ্ধ অটোমেশন সুবিধা চালু হচ্ছে। নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলার পর চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা হয়ে ঢাকা পর্যন্ত আড়াইশ কিলোমিটার পাইপলাইনে দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে তিন কোটি লিটার তেল পদ্মা অয়েল কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছে। বছরে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহের সক্ষমতা নিয়ে নির্মিত এই পাইপলাইনে বর্তমানে ৩০ লাখ টন তেল যাবে কুমিল্লার বরুড়া এবং নারায়ণগঞ্জের গুদনাইলফতুল্লা ডিপোতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হলে কোটি কোটি টাকার তেল অপচয়, চুরিসহ নানা অনিয়ম ঠেকানোর মাধ্যমে প্রতি বছর অন্তত আড়াইশ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।

সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে বছরে গড়ে ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ টন জ্বালানি ব্যবহৃত হয় ঢাকা বিভাগে। এই তেলের প্রায় পুরোটা পতেঙ্গার গুপ্তখাল প্রধান ডিপো থেকে নৌপথে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল, ফতুল্লা ও চাঁদপুর ডিপোতে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সড়কপথে পরিবহন করা হয়। রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমেও কিছু জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়।

দেশের জ্বালানি তেলের ৯০ শতাংশ পরিবাহিত হয় নৌপথে। তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রায় ২০০টি অয়েল ট্যাংকার এসব জ্বালানি তেল পরিবহন করে। নৌপথে জ্বালানি তেল পরিবহনে সিস্টেম লসের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে। তাছাড়া শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা কমে যাওয়ায় জ্বালানি তেল পরিবহনে সংকট তৈরি হয়। অপরদিকে বেসরকারি খাতের অন্তত ৩০ হাজার ট্যাংক লরির পাশাপাশি রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে সড়ক ও রেলপথে জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয় দেশের নানা অঞ্চলে।

জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জ্বালানি পরিবহনের সিস্টেম লস কমানো, নৌপথে তেল পরিবহনের বিপুল খরচ সাশ্রয়সহ দ্রুত তেল পৌঁছানোর লক্ষ্যে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা হয়ে নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার ফতুল্লা পর্যন্ত আড়াইশ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। ‘চট্টগ্রাম হতে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৬ সালের অক্টোবরে একনেকের অনুমোদন পায়। কথা ছিল ২০২০ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। কিন্ত নানা প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিকূলতার মাঝে পড়তে হয় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটিকে। পরে সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। এর ফলে পদ্মা অয়েল কোম্পানির তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করছে।

প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার বরুড়া এবং নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত ৭টি স্টেশনসহ ২৪১.২৮ কিলোমিটার ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন নির্মাণ, গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত দুটি স্টেশনসহ ৮.২৯ কিলোমিটার ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন নদীর তলদেশ দিয়ে অন্তত ৯ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে।

প্রকল্পটির আওতায় কুমিল্লার বরুড়ায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ নতুন একটি ডিপো স্থাপন করা হয়েছে। ওখান থেকে বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের প্রয়োজনীয় সব ডিজেল যোগান দেওয়া হবে। বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে বর্তমানে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর এবং আশুগঞ্জ ডিপো থেকে সড়কপথে জ্বালানি তেল সরবরাহ দেওয়া হয়; যা সময় এবং ব্যয় সাপেক্ষ। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে অপচয় ও সিস্টেম লস হয়। অটোমেশন প্রযুক্তি সমৃদ্ধ বরুড়া ডিপো চালু হওয়ার পর বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের তেলের যোগান চট্টগ্রাম থেকে পাইপলাইনে হবে। চাঁদপুর ডিপো তখন কেবল পেট্রোল এবং অকটেন বিক্রি করবে। চাঁদপুরের প্রয়োজনীয় ডিজেলও বরুড়া থেকে সরবরাহ করা হবে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এই ডিপো থেকে চাঁদপুর এবং আশুগঞ্জসহ বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে ডিজেল সরবরাহ করা হবে।

বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ডেসপ্যাচ টার্মিনালের স্ক্যাডা মাস্টার কন্ট্রোল স্টেশন থেকে ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা হবে। স্ক্যাডা, টেলিকমিউনিকেশন এবং লিক ডিটেকশন করতে এই পাইপলাইনের সাথে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল লাইন সংযুক্ত থাকবে। এতে জ্বালানি তেলের সিস্টেম লসসহ সব ধরনের অনিয়ম ঠেকানো সম্ভব হবে।

সেনাবাহিনী ও পদ্মা অয়েল কোম্পানির তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত প্রকল্পটির কমিশনিং শুরু করা হয়েছে। এই পাইপলাইনের অপারেশন্স সম্পন্ন করার জন্য তিন কোটি লিটার ডিজেল প্রয়োজন, যা পদ্মা অয়েল কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছে। এজন্য পদ্মা অয়েল কোম্পানিকে প্রতি লিটার ১০০ টাকা ২৫ পয়সা করে মোট ৩শ কোটি ৭৫ লাখ টাকা প্রকল্প থেকে পরিশোধ করা হয়েছে। ৩ কোটি লিটার ডিজেল দিয়ে পাইপলাইন এবং ডিপোর কার্যক্রম পরীক্ষানিরীক্ষা করে সবকিছু বিপিসিকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। তিন কোটি লিটার তেল পাইপলাইনেই থেকে যাবে। পরে যে কোম্পানির যা প্রয়োজন তা পাইপলাইনে দিয়ে বুঝে নেওয়া হবে। অর্থাৎ নতুন তেল পাইপলাইনে গেলে আগের তেল ডিপোতে যাবে। আড়াইশ কিলোমিটার পাইপলাইনে সবসময় তিন কোটি লিটার ডিজেল জমা থাকবে। বরুড়া ডিপো থেকে পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম এবং যমুনা অয়েল কোম্পানিকে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে। এখানে পৃথক পৃথক ডেলিভারি পয়েন্টের মাধ্যমে তিন বিপণন কোম্পানির হিসেব পরিচালিত হবে।

বিপিসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সবকিছু চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পদ্মা অয়েল কোম্পানির গুপ্তাখাল প্রধান ডিপোর ২০১ এবং ২০২ নম্বর ট্যাংক থেকে পাইপলাইনে তিন কোটি লিটার ডিজেল সরবরাহ দেওয়ার পর শেষবারের মতো পাইপলাইন পরীক্ষা করে দেখা হবে। এরপর কুমিল্লার বরুড়ায় নির্মিত নতুন ডিপোর অটোমেশনসহ আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলো পরীক্ষানিরীক্ষা করে চূড়ান্তভাবে তেল পরিবহন শুরু হবে। সবকিছু মিলে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তিনি বলেন, পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের আধুনিক সিস্টেম চালু হলে দেশের জ্বালানি তেল সেক্টরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। নিশ্চিত হবে জ্বালানি নিরাপত্তা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারিনি : সালাহউদ্দিন
পরবর্তী নিবন্ধলন্ডনের সেই ফ্ল্যাট নিয়ে ‘মিথ্যা বলেছিলেন’ টিউলিপ : ডেইলি মেইল