কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে ফের গোলাগুলিতে দুইজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। পারস্পরিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গতকাল রোববার ভোরে দুই গ্রুপের মধ্যে হামলা পাল্টা হামলার এ ঘটনা ঘটে। এসময় আহত হয়েছে কমপক্ষে ১৫ জন। সংঘর্ষে জড়িত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পের ১৫ টি ঘরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইয়াবা, স্বর্ণ ব্যবসার দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, ছিনতাইয়ের মত অপরাধ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা দফায় দফায় গোলাগুলি, হামলা পাল্টা হামলার ঘটনায় অন্তত চারজন নিহত ও অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা আহত হয়েছে। প্রথম গত ২৬ আগস্ট গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এর পর থেকে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পুরাতন রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পের ই-ব্লকের মোহাম্মদ ফরিদ ও এফ ব্লকের নুর হাশিম, মাস্টার মুন্না এবং আন- রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পের আল-ইয়াকিন নেতা রফিক উদ্দিন, হাফেজ জাবেদ ও সাইফুলের মধ্যে অন্তঃকোন্দল শুরু হয়। ঘটতে থাকে একের পর এক হামলা পাল্টা হামলা। অশান্ত হয়ে ওঠে পরিবেশ।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববার (৪ অক্টোবর) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং -২/ ওয়েস্ট ক্যাম্পের ব্লক ডি-২ এবং ২ ই-ব্লকের মাঝামাঝি স্থানের ক্যাম্পে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে নিহতরা হলেন, ওই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইমাম শরীফ (৩০) ও শামশুল আলম (২৮)। আহতদের মধ্যে সেলিম ও সাদেক ছাড়া বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ক্যাম্পের বিভিন্ন স্বাস্থ্য ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে গত ১ অক্টোবর রাতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গোলাগুলিতে ২/ওয়েস্ট ক্যাম্পের এক মহিলা নিহত হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে স্থানীয় মুন্না গ্রুপ ও আনাস গ্রুপের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে একের পর এক সংঘর্ষ চলে আসছিল।
এসব ঘটনায় কুতুপালং পুরাতন নিবন্ধিত, ১/ওয়েস্ট ইস্ট, ২ /ওয়েস্ট ও ইস্ট, ৩নং, ৫ নং ক্যাম্পে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গাদের অভিযোগ- মিয়ানমার সরকার ও আর্মির গোয়েন্দারা বিপুল অর্থ ঢেলে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলছে। নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, রোহিঙ্গাদের জেনোসাইড মামলার ঘটনায় মিয়ানমার যেটি চেয়েছিল তা-ই হচ্ছে। এ বিচার কাজকে বানচাল করতেই সবকিছু করা হচ্ছে।
এতে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা ক্যাম্পের অপরাধ কর্মকাণ্ডগুলো তুলে ধরে প্রমাণ করতে চাইবে রোহিঙ্গারা নিজেরা ঘটনা ঘটিয়ে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে বেকায়দায়
ফেলতে ষড়যন্ত্র করেছে। এছাড়াও গত কয়েকমাস আগে ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত নিয়মিত পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করে ১৪ ও ১৬ ব্যাটালিয়ন আর্মড পুলিশ ব্যাটলিয়ন বা এপিবিএন নিয়োজিত করার পর স্বাভাবিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে বলে রোহিঙ্গাদের অভিমত।
২নং ওয়েস্ট ক্যাম্পের আবদুল মুনাফ জানান, গত মাসাধিককাল ধরে পুরাতন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে নতুন রোহিঙ্গারা জিম্মি হয়ে পড়ছে। পথে, হাটে, দোকানে যেখানে পাচ্ছে নতুন রোহিঙ্গাদের মারধর করে সর্বস্ব ছিনিয়ে নিচ্ছে। প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীও নতুন রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
উখিয়ার কুতুপালং ও মধুরছরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্বরত ১৪নং এপিবিএনের ইন্সপেক্টর ইয়াছিন ফারুক বলেন, ‘নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপের সঙ্গে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার ভোরে দুু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এপিবিএন সদস্যরা জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ দৌজা জানান, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে রেজিস্ট্রার্ড এবং আন-রেজিস্ট্রার্ড কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে দুই জন নিহত হয়েছে। ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি আহমেদ সন্জুর মোর্শেদ জানান, রোহিঙ্গা দুই গ্রুপের সংঘর্ষের খবরে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ। নিহত দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কক্সবাজার থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এনে মোতায়েন করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের আটকে বিশেষ অভিযান চলছে বলে তিনি জানান।