কী লিখি? কীভাবে লিখি?

(লেখালেখির আর্ট এবং ক্রাফট বিষয়ক কথাবার্তা) আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

ভাষান্তর: এমদাদ রহমান | শুক্রবার , ১৪ জুন, ২০২৪ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

ল্যারি ডব্লিউ ফিলিপ্স সম্পাদিত ‘হেমিংওয়ে: অন রাইটিং’ বইটি যেদিন প্যারিসের ‘শেকস্‌পিয়র এন্ড কোম্পানি’ থেকে কিনেছিলাম, সেদিন মেট্রো রেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম হেমিংওয়েকে খুঁটিয়ে পড়া কত জরুরি। প্যারিস রিভিউয়ে প্রকাশিত জর্জ প্লিম্পটনের নেয়া আর্ট অফ ফিকশন সাক্ষাৎকার, হেমিংওয়ের চিঠিপত্র, তরুণ লেখকদের সঙ্গে বিনিময়, এবং তার ‘বাইলাইন’, কিছু অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, ‘গ্রিন হিলস অফ আফ্রিকা’, ‘ডেথ ইন দি আফটারনুন’, ‘এ মুভেবল ফিস্ট’এসব বইয়ে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লেখালেখি নিয়ে বিস্তর কথা বলেছেন, যা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সেসব কথারই অনুবাদ করা হলো।

মাঝে মাঝে এমন হতো, যখন, নতুন একটি গল্প শুরু করেছি কিন্তু কিছুতেই গভীরে যেতে পারছি না, এগোতে পারছি না, তখনআগুনের কাছে বসে, সেই আগুনের শিখায় কমলার খোসা ধরে রাখতাম; তাতে কী হতো? নীলাভ আগুনের ছিটকেপড়া থোকা দেখতাম! জানালা দিয়ে প্যারিসের বাড়িগুলোর ছাদ দেখতে দেখতে ভাবতাম, ‘ভেঙে পড়ার কিছুই নেই। তুমি আগেও গল্প লিখেছ, এখনও পারবে। এখন তোমাকে যা করতে হবে, তা হল একটি সত্য বাক্য লেখা। এক্ষনি তুমি জীবন থেকে শেখা সবচে সত্য যেবাক্যটি জানো, সেই বাক্যটি লিখে ফেল।’ অতঃপর আমি, শাদা কাগজের সামনে সবচে একা এক লেখক, একটি সত্য বাক্য লিখতাম, আর পেয়ে যেতাম লেখার পরের বাক্যগুলো।

সারা জীবন আমি শব্দদের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থেকেছি যেন জীবনে এই প্রথমবার আমি তাদের দেখছি

ইঁদুর (জনৈক তরুণ লেখক) : একজন লেখকের জন্য সবচে ভালো প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কী?

হেমিংওয়ে: তার অসুখি শৈশব

এখানে খুব পড়ছি। আমার কাছে তুর্গেনেভ হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক। হ্যাঁ, সর্বশ্রেষ্ঠ বই তিনি লেখেননি, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক তিনি ছিলেন। তিনি আমার কাছে বিশাল কিছু অবশ্যই। আপনি কি কখনও তার ‘চাকার ঘূর্ণি (দ্য র‌্যাটল অফ হুইলস) গল্পটি পড়েছেন? আ স্পোর্টসম্যানের স্কেচের ২য় খণ্ডের গল্প। ‘ওয়ার এন্ড পীস’কে আমি সেরা বই হিসেবে জানি কিন্তু কল্পনা করুন তো, যদি তুর্গেনেভ এটি লিখতেন, তবে তা কী হতে পারত! চেকভ প্রায় ৬টি ভালো গল্প লিখেছেন কিন্তু তিনি ছিলেন অ্যামেচার লেখক। টলস্টয় একজন প্রফেট। মোপাসঁ ছিলেন পেশাদার লেখক, বালজাকও পেশাদার লেখক কিন্তু তুর্গেনেভ সত্যিকার একজন আর্টিস্ট।

দস্তইয়েভ্‌স্কি’র কথা ভাবছি, আমি বললাম– ‘একটা মানুষ কীভাবে এত খারাপ লিখতে পারে, এতো অবিশ্বাস্যরকমের খারাপ, তারপরও মানুষটি কীভাবে আপনাকে এতো গভীরভাবে ভাবাতে পারে?’

 

ইঁদুর: লেখককে কোন বইগুলো পড়তে হবে?

হেমিংওয়ে: তার সবকিছু পড়া উচিত যাতে তিনি জানেন যে তাকে কী করতে হবে।

ইঁদুর: তিনি তো সব কিছু পড়তে পারবেন না।

হেমিংওয়ে: আমি বলি না তিনি কী করতে পারেন, আমি বলি তার কী করা উচিত। অবশ্যই তিনি সব পারবেন না।

ইঁদুর: তার জন্য জরুরি বই কোনগুলো?

হেমিংওয়ে: তার জন্য জরুরি টলস্টয়ের ‘ওয়ার এন্ড পীস’ এবং ‘আনা কারেনিনা’, ক্যাপ্টেন ম্যারিয়েটের ‘পিটার সিম্পল’, ‘মিডশিপম্যান ইজি’ এবং ‘ফ্র্যাঙ্ক মিলডমে’, ফ্লবেরের ম্যাদাম বোভারি এবং লে’দুকেসিয়ঁ সেন্তিমন্টাল, টমাস মানের বুডেনব্রুকস, জয়েসের ডাবলিনার্স, ‘পোর্ট্রেট অফ দি আর্টিস্ট’ এবং ইউলিসিস, ফিল্ডিঙের ‘টম জোনস এবং জোসেফ অ্যান্ড্‌রুস’, স্তাঁদালের ল্য রুজ এ লে নুয়া (লাল এবং কালো), এবং ‘পার্মার মদিরা’; দস্তইয়েভ্‌স্কি’র ‘কারামাজভ ভাইয়েরা’ এবং আরও দুএকটি লেখা, টোয়েনের হাকলবেরি ফিন, স্টিফেন ক্রেনের ‘দি ওপেন বৌট’, ‘দ্য ব্লু হোটেল’, জর্জ মুরের হেইল এন্ড ফেয়ারওয়েল; ইয়েটসের আত্মজীবনী, মোপাসঁর ভালো লেখাগুলি; কিপলিঙের ভালো লেখাগুলি, তুর্গেনেভের সমস্ত লেখা, ডব্লিউ এইচ হাডসনের ‘বহু দূরে, বহু আগে’; হেনরি জেমসের ছোটগল্পগুলো, বিশেষ করে ম্যাডাম ডি মাউভস এবং দ্য টার্ন অফ দ্য স্ক্রু, দ্য পোর্ট্রেট অফ এ লেডি, দ্য আমেরিকান

ইঁদুর: আমি তো এত দ্রুত লিখতে পারি না। আর কত আছে?

হেমিংওয়ে: বাকিটা আরেকদিন। এর সংখ্যা প্রায় তিনগুণ।

ইঁদুর: লেখককে কি এসব পড়তেই হবে?

হেমিংওয়ে: হ্যাঁ, এ সব এবং আরও অনেক কিছু। না হলে তিনি জানবেনই না তাকে কোথায় আঘাত করতে হবে।

ইঁদুর: আপনার এই ‘আঘাত করতে হবে’ কথাটির মানে কী?

হেমিংওয়ে: শুনুনযা লেখা হয়ে গেছে তা লিখে কোনও লাভ নেই যদি না আপনি লেখাটিকে অতিক্রম করতে পারেন। আমাদের সময়ের একজন লেখককে যা করতে হবে তা হলোযা আগে লেখা হয়নি তা লিখতে হবে

ইঁদুর: কিন্তু সব ভালো লেখকদের পড়া একজন লেখককে নিরুৎসাহিত করতে পারে।

হেমিংওয়ে: তাহলে তাকে নিরুৎসাহিত করা উচিত।

আমি সহজ জিনিস দিয়ে শুরু করে লিখতে শেখার চেষ্টা করেছিলাম

শীতের হিম বৃষ্টির সঙ্গে হঠাৎ যেন প্যারিসের সমস্ত বিষাদ নেমে আসে; আর রাস্তার স্যাঁতসেঁতে সজলনরম অন্ধকার, ছোট ছোট দোকান, ভেষজ বিক্রেতা, খবরের কাগজের দোকান, বন্ধ দরোজা, আর সেই হোটেল, যেখানে পল ভেরলেন মারা গিয়েছিলেন, যার চূড়ায় একটি ঘরে আমি লেখালেখি করি এসবের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমার মনে হয়: এগুলো ছাড়া শাদা শাদা উঁচু বাড়িগুলোর উপর আর কিছুই নেই!

ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাটি ঊনচল্লিশবার লিখবার পর সন্তুষ্ট হয়েছিলাম।

প্যারিস রিভিউ: আপনি কি সেই মুহূর্তের কথা মনে করতে পারেন যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লেখক হবেন?

হেমিংওয়ে: আমি সবসময় লেখকই হতে চেয়েছিলাম।

যাচ্ছেতাই ব্যবহারে আমাদের সমস্ত শব্দ তীব্রতা হারিয়েছে

ইঁদুর: যখন গল্প লিখছেন, তখন কি বুঝতে পারেন কী ঘটতে চলেছে?

হেমিংওয়ে: কখনোই না, বুঝতে পারি না; লেখাটি এগোতে থাকে, আর যা কিছু ঘটবার তা ঘটতে থাকে, নিজে নিজেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে ‘রেঙ্গুইন্যা সুন্দরী’
পরবর্তী নিবন্ধপাঁচলাইশে সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার