কী চায় বাংলাদেশ

বিবিসি বাংলা | বুধবার , ২১ অক্টোবর, ২০২০ at ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ

অর্থনৈতিক শক্তি আর সামরিক সক্ষমতার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সেদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার প্রচারণা কিংবা গতি-প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব। নির্বাচনে যে প্রার্থীই বিজয়ী হোক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ কী চায় বা কী পেতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেশটির সহযোগিতা প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। যদিও এ বিষয়ে তারা একমত, বাংলাদেশের জন্য সেখানে কোন দলের কে বিজয়ী হলেন তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতি হুট করে পরিবর্তন করে না।
দুই দেশের নীতির ক্ষেত্রে অনেক সময় পারস্পরিক মতভিন্নতা দেখা গেলেও সার্বিকভাবে তা বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক কিছু নয় বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, আমেরিকার কাছ থেকে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ যা পেতে পারে তা হলো বাণিজ্য ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে দেশটির শক্ত অবস্থান, রপ্তানি ক্ষেত্রে সুবিধার পাশাপাশি ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট এবং বৈধ অভিবাসনে আরও উদারতা। তিনি বলেন, গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকারের মতো ইস্যুগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র হয়ত আপত্তি করে। কিন্তু তাদের অবস্থান কখনো বাংলাদেশের জন্য প্রতিকূল হয়নি। জিএসপিটা হয়ত আপাতত দেবে না। তবে এটিই হতে পারত বাংলাদেশের বড় প্রাপ্তি। এখন ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টটা যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে বাংলাদেশ শুরু করতে পারলেও সেটি ইতিবাচক হবে।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে বাংলাদেশকে আরও সহায়তা করুক যুক্তরাষ্ট্র, এটিই সর্বাগ্রে চাওয়া থাকবে বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশিয়ায় যে কৌশলগত অবস্থানের কথা যুক্তরাষ্ট্র বলছে, সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন গুরুত্ব পাক ও বাংলাদেশের উন্নয়নে আরও বেশি বিনিয়োগ নিয়ে তারা এগিয়ে আসুক, এটিই বাংলাদেশ চাইছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে আগেই। দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য আছে ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (টিকফা)।
দুই দেশের সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি : ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর গত ৪৮ বছরে দুই দেশের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে। বিশেষ করে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই এখন এককভাবে বড় দেশ। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে আসা প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবের পরে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান।
২০০০ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন বিল ক্লিনটন। পরে ২০১২ সালে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটি কৌশলগত চুক্তি হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের অনুরোধে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে কসোভাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশ যা রপ্তানি করে তার এক-পঞ্চমাংশই যুক্তরাষ্ট্রে করে। আবার প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগকারী এবং কৌশলগত সামরিক মিত্র হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
পোশাক রফতানি ও অর্থনীতি : রাষ্ট্রদূত কবির বলেন, বাংলাদেশের প্রধান চাওয়া হবে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হোক এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার। ব্লু ইকোনমির বিস্তৃত দিগন্ত সামনে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সেখানে বড় বিনিয়োগ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের আগ্রহ ও সক্ষমতা আছে। তবে তাদের প্রশাসন আরও কার্যকরভাবে এগিয়ে আসুক-এটিই বাংলাদেশ চাইছে।
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির পরিমাণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় শীর্ষ স্থানে রয়েছে। এ রপ্তানি আরও বাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে সরকার ও রপ্তানিকারকরা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাকে শুল্ক আরোপ করে। অথচ পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের জন্য শুল্ক নেই।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, রানা প্লাজার সময় ১৪টা শর্ত দিয়ে জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরে এসব শর্ত পূরণ করলেও তারা আর এ সুবিধা ফেরত দেয়নি। অনেক লবিং হয়েছে। কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি। তবে জিএসপি না দিলেও আমরা চাই আমেরিকা থেকে আনা কটন দিয়ে তৈরি পোশাক সেখানে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ দিক তারা। তিনি বলেন, কারখানার মান, পণ্য মান, কাজের পরিবেশ, শ্রম উন্নয়নসহ সবকিছুতে বাংলাদেশের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। তারা চান, তৈরি পোশাকের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আরও উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিক।
পররাষ্ট্রনীতি ও রোহিঙ্গা ইস্যু : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের আরও শক্ত অবস্থান নেওয়ার সুযোগ আছে। এটি বাংলাদেশ প্রত্যাশা করতে পারে। তিনি বলেন, চীনকে কেন্দ্র করে আমেরিকার স্বার্থেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়ার সুযোগ আছে দেশটির এবং এটিই বাংলাদেশের এ মুহূর্তে বড় চাওয়া। কারণ আমেরিকা চাইলেই মিয়ানমারকে চীনা বলয় থেকে বের করতে পারবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আমেনা মোহসিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে সম্মান করতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কংক্রিট অবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্রের এবং বাংলাদেশ চায় যুক্তরাষ্ট্র সেটুকুই করুক।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মডারেট মুসলিম শব্দ ব্যবহার করে ধর্মীয় ট্যাগ না দিয়ে বাংলাদেশকে বরং অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করার সময় এসেছে। বাংলাদেশ কারও সাথে যুদ্ধে নেই। আবার কোনো এলায়েন্স পলিটিঙেও নেই। বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে বিশেষ করে তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য ও ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরও সহযোগিতার সুযোগ আছে।
অভিবাসন ও রেমিটেন্স : যুক্তরাষ্ট্র হলো কান্ট্রি অব ইমিগ্র্যান্টস। অর্থাৎ অভিবাসীদের দেশ। ওই দেশে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় আট লাখ। অনেকে এ সংখ্যা দশ লাখের বেশি বলে মনে করেন।
আমেনা মহসিন বলেন, স্টুডেন্ট ভিসার ক্ষেত্রে আরও উদারতা ও ইমিগ্র্যান্টসদের প্রতি আরও সহানুভূতিই হবে বাংলাদেশের অন্যতম চাওয়া।
তৌহিদ হোসেন বলেন, বৈধ অভিবাসনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক এবং সামনে বাংলাদেশীদের জন্য এ সুবিধা থাকবে বলেই মনে করেন তিনি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকলে ইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা সহজ। সে কারণেই বহু শিক্ষার্থী এখনো যেতে পারছে। বাংলাদেশ চাইবে এটি যেন অব্যাহত থাকে। বৈধ অভিবাসনে বাংলাদেশিদের জন্য ভালো জায়গা যুক্তরাষ্ট্র।

পূর্ববর্তী নিবন্ধট্রাম্প-বাইডেন শেষ বিতর্কে থাকছে মিউট বাটন
পরবর্তী নিবন্ধএবার আলুর কেজি ৩৫ টাকায় বেঁধে দিল সরকার