ঢাকায় ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের আগে বিএনপির তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে যে উচ্চাশা ও উচ্ছ্বাস ছিল, দৃশ্যত তাতে এখন ভাটা পড়েছে। বিএনপির ফেইসবুক পেইজের ভিডিওতে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারের সংখ্যাও কমে গেছে। মাঠের চিত্রেও দেখা গেছে হরতাল ও অবরোধের টানা কর্মসূচিতেও মিছিল চোখে পড়ে কদাচিৎ। রাজধানী ঢাকাতে জড়ো হওয়ার চেষ্টার দেখা মেলে না একেবারেই।
যদিও গত এক বছর ধরে নেতারা বলে আসছিলেন, তাদের চূড়ান্ত আন্দোলনে লক্ষ্য থাকবে ঢাকা। তবে সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের পরদিন গত ২৯ অক্টোবর থেকে টানা কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশ কারাগারে, বাকিরা আত্মগোপনে। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবন্ধ।
এর মধ্যেই ঘোষণা হয়ে গেছে নির্বাচনী তফসিল। ভোটের দিনক্ষণ জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগও নির্বাচনী ট্রেন ছেড়ে দিয়ে তাতে উঠতে আহ্বান জানিয়েছে বিএনপিকে। এর প্রতিবাদে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে থাকা বিএনপি ও সমমনারা আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েই চলেছে। অবরোধ শেষ হতে না হতেই আবারও আগামীকাল রোববার থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডাক এসেছে। খবর বিডিনিউজের।
তবে টানা এসব কর্মসূচির প্রভাব জনজীবনে থাকলেও তা সরকারকে চাপে ফেলতে পারছে এমন নয়। কারণ, অফিস–আদালত সবই চলছে স্বাভাবিকভাবে। দূরের পথে যাত্রীবাহী বাস চলাচলে ব্যাঘাত হলেও পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকতেই দেখা গেছে। এবার ব্যবসায়ীদের থেকেও রাজনৈতিক সমঝোতার ডাক সেভাবে আসছে না। আগের বছরগুলোর মতো কূটনীতি পাড়ার তৎপরতাও খুব একটা দৃশ্যমান নেই। এ অবস্থায় বিএনপির তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে হতাশার বিষয়টি স্পষ্ট বলেই মানছেন দলটিরই অনেকে।
নোয়াখালীর শরীফুল ইসলাম বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কর্মী। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসার পর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে। তার ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম বলেন, বড় ভাইকে পুলিশ ধরেছে শুনে খোঁজ পেয়ে ঢাকায় এসেছি। তবে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি।
তার এলাকায় ৯ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে জানিয়ে তিনি বলেন, এভাবে কত দিন, এর শেষ কোথায়? আমরা মনে করেছিলাম একটা কিছু হবে, সরকার আর যাই করুক একতরফা নির্বাচনের দিকে যাবে না। একটা সমঝোতার পথ খুলবে। কিন্তু কোনটাই তো হলো না।
বিএনপির হরতাল–অবরোধের মধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় অনেক নেতা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলন বিএনপি ২০১৩ সালেও করেছিল। পরের বছরের ৫ জানুয়ারির ভোটকে সামনে রেখে কর্মসূচি ছিল আরও বেশি জোরালো, সহিংসতাও হয়েছিল। বিরোধীদের বর্জনের মুখে এর আগেও নির্বাচন হয়েছে বাংলাদেশে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা নিয়ে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। অক্টোবরে হাই কোর্ট সাজা বাড়িয়ে করে ১০ বছর। ওই বছরের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে আবার আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই ভোটে আসে দলটি। তাদের ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রট নামে ঘোষণা হয় আরও একটি জোট। ভোটে এসব জোটের ভরাডুবিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবারও সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে ওই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও রাতে ভোট চুরির অভিযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে বিএনপি।
ভোটে আসার প্রশ্নে বিএনপিতে বিভক্তি প্রকাশ্যে : বিএনপি আবার এক দশক আগের আন্দোলনে ফিরে যাওয়ার পর দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তিনি মনে করেন তার দলের ভোটে যাওয়া উচিত। এই নেতা মনে করেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করাটাই ভুল ছিল। সে কথা গত এক দশকে বারবার বলেছেনও।
হাফিজের নেতৃত্বে নতুন দল হচ্ছে–তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এমন একটি কথা বলে রাজনীতিতে চমক তৈরি করেছিলেন। তবে হাফিজ পরে সংবাদমাধ্যম কর্মীদের ডেকে বলেছেন, এমনটি তার ভাবনাতে নেই। ৮ নভেম্বরের সেই সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির আন্দোলনের কথা তুলে ধরে হাফিজ বলেন, সশস্ত্র প্রতিরোধের সামনে নিরস্ত্র ব্যক্তি কতটুকু করতে পারে? আমি মনে করি বিএনপির এই নির্বাচনে যাওয়া উচিত।
বিএনপির দলছুট নেতাদের নেতৃত্বে গঠন করা তৃণমূল বিএনপির চমকের ঘোষণার মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির দুজন নেতা সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তারা ভোটে যাবেন। সঙ্গে থাকবেন শতাধিক নেতা। এ দুই নেতা হলেন খন্দকার আহসান হাবিব ও এ কে এম ফখরুল ইসলাম। এদের মধ্যে আহসান হাবিবের বাড়ি টাঙ্গাইলে এবং ফখরুল ইসলামের বাড়ি ঝালকাঠিতে। দ্বিতীয়জন মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় ফাঁসের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। তিনি বিএনপি নেতার হয়ে আদালতে আইনি লড়াই করেছিলেন।
আহসান হাবিবের জেলা টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের বিএনপি সমর্থক আনোয়ার সিকদার বলেন, এভাবে আত্মগোপনে থেকে বিএনপির রাজনীতিকে এগুনো যাবে না। জনগণকে নিয়ে তাকে রাজনীতি করার পথ খুঁজতে হবে। দেখুন দলের দুজন এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলছেন, স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন। খোঁজ নিয়ে দেখেন এ রকম আরও অনেককে খুঁজে পাবেন, যদিও তারা প্রকাশ্য বলছেন না।
বিএনপির কর্মী ঠাকুরগাঁওয়ের সোহরাব উদ্দিন সাজুও মনে করেন ভোট থেকে দূরে থাকাটা সমাধান নয়। গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে নেতাকর্মীদের আত্মগোপনে চলে যাওয়া নিয়ে তিনি হতাশ খানিকটা। তিনি বলেন, এভাবে আত্মগোপনে থেকে রাজনীতি বিএনপিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এটা ভাবতে হবে। বিএনপির উচিত কৌশল পরিবর্তন করা।
এ মত বিএনপির অনেকেই পছন্দ করবেন না, এটা জানেন সাজু। তিনি বলেন, অনেকে আমাকে দালাল বলবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারকে হটানোর এবারের আন্দোলনে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বিএনপি একাট্টা। সকল বাম–গণতান্ত্রিক দলগুলো নিয়ে বিএনপির যুগপৎ জোটও শক্তিশালী।
তৃণমূলের প্রতি বার্তাটা কী? : একটি বেসরকারি বীমা কোম্পানির কর্মকর্তা সায়মা খাতুন বিএনপির সমর্থক। তিনি বলেন, বিএনপি বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। কেন? একটু বিশ্লেষণ করা দরকার।
নিজের বিশ্লেষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ক্ষমতায় বাইরে ১৭ বছর। নির্বাচন আসলে বয়কট করবেন। এটা তো হতে পারে না। সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলেও শুধু নির্বাচন বর্জনের কি সমাধান আসবে? নিশ্চয় নয়। কৌশল যেটা তারা নিচ্ছেন তার বিকল্প থাকতে হবে। এবারে দেখা গেছে সরকারের ক্র্যাকডাউনে নেতারা সব আত্মগোপন চলে গেলেন, অনেকে গ্রেপ্তার হলেন। তাহলে তৃণমূলের প্রতি বার্তাটা কী? সেটা আমরা কিছুই জানতে পারছি না।
বিএনপির এ বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও আছে ঝামেলা। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে পুলিশ সরে গেলেও নেতাকর্মীরা ভিড়ছেন না সেখানে। কারণ ২৮ অক্টোবর কাকরাইল ও বিজয়নগরে সংঘর্ষের ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে, তাতে আসামি কয়েক হাজার। কেন্দ্রীয় নেতাদের সিংহভাগেরই নাম আছে। তাদের মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও মির্জা আব্বাসসহ নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের বহু নেতাই গ্রেপ্তার হয়েছেন।
তৃণমূলে হতাশা এবং নির্বাচন বর্জন নিয়ে নেতাদের মধ্যে ভিন্ন চিন্তা; বিএনপি তবে কী করবে? এ প্রশ্নে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সরকার খুব পরিকল্পিতভাবে একতরফা নির্বাচনের ছক তৈরি করেছে। বিএনপিকে বাদ দিয়ে তারা নির্বাচন করবে সেইজন্যই ওদের নীল নকশা। তারা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সরকার না হয় নীল নকশা করেছে, আপনারা কী করছেন? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, একতরফা নির্বাচন রাজনৈতিক যে সংকট তৈরি হয়েছে এটাকে রাজপথেই মোকাবিলা করতে হবে। অন্য কোনো পথে এর সমাধান নেই। আমি বিশ্বাস করি, অবশ্যই এর সমাধান আসবে, আসতেই হবে। বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল দৃঢ়, ফয়সালা হবেই হবে। রাজপথে মোকাবিলা কীভাবে হবে, কেন বিএনপি এবার সফল হবে ভাবছে, সে প্রশ্নে অবশ্য কিছু বলতে পারেননি খোকন।
ভোটে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে যেসব প্রশ্ন উঠছে, সেসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমাদের দাবিও স্পষ্ট, সরকারের পদত্যাগ এবং একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। এই দাবি এখন শুধু বিএনপির নয়, জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। সেখানে যদি কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যায়, তার জন্য দলের অবস্থান কঠোর হবে।