চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা জগতের একজন স্মরণযোগ্য মানুষ ও আধুনিক সংবাদপত্রের পথিকৃৎ,সংবাদপত্র শিল্পের অন্যতম অগ্রদূত, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনপ্রিয় সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক চট্টল গৌরব ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক সাহেব এর ৬১ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। চট্টগ্রামের আপাময় মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত,স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী ৬৪ বছরে পদার্পণ করেছে। ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীর পথচলা শুরু হয়েছিল। দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক ছিলেন এই অঞ্চলের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার। ৬৩ বছর আগে এখানকার মাটি ও মানুষের কথা বলার জন্য তিনি প্রকাশ করেন দৈনিক আজাদী। শুধুমাত্র চট্টগ্রামের মানুষের অভাব অভিযোগ তুলে ধরার জন্য তিনি পত্রিকা প্রকাশনার মতো একটি অলাভজনক কাজ শুরু করেন।
ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক ছিলেন চট্টগ্রামের মানুষের চেতনার বাতিঘর। একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। তিনি সমাজে পরিবর্তন আনার জন্যই সারাজীবন কাজ করেছেন। কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয়, চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের কথা বলার জন্যই মূলত তিনি দৈনিক আজাদী প্রকাশ করেছিলেন। চট্টগ্রামবাসীর জন্য উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা ছিলেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদী ও চট্টগ্রাম একে অপরের পরিপূরক। দৈনিক আজাদী পত্রিকাকে বাদ দিলে চট্টগ্রাম নিয়ে আলোচনা চলে না। আবার ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে বাদ দিলে চট্টগ্রামের ইতিহাস বিশেষ করে আধুনিক মানুষের মনন চর্চার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সংবাদপত্র জগতে না এসে অন্য কাজও করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ওই সময়েই চিন্তা করেছিলেন চট্টগ্রামের মানুষের মনের কথা, মানুষের সুখ–দুঃখের কথা, মানুষের সমস্যা এবং চট্টগ্রামের অপার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরার জন্য সংবাদপত্রের বিকল্প নাই। তাই তিনি পত্রিকা প্রকাশনার পথে আসেন এবং তার আসাটা সার্থক হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলার ঐতিহ্যবাহী রাউজান সুলতানপুর গ্রামে ১৮৯৬ সালের ২০ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ৬৬ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। সংবাদপত্র ও আধুনিক মুদ্রণ শিল্প জগতের পথিকৃত চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক–এর বিচরণ বা অবদান অন্তত চট্টগ্রামবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার খুব প্রয়োজন নেই। তিনি রাউজান সুলতানপুর গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে রাউজান আরআরএসি ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯১২ সালে প্রবেশিকা এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯১৯ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে স্বর্ণপদকসহ তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা পেশার মধ্যদিয়ে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে কিছুকাল রেঙ্গুনে চাকুরী করেন। চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপলাই কোম্পানীতে তড়িৎ প্রকৌশলী হয়ে যোগদান এবং চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পরে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। চট্টগ্রামের শিক্ষা–সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় পৃষ্ঠপোষকতা এবং এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। যা ছিল এ অঞ্চলের প্রথম বিদ্যুৎ চালিত ছাপাখানা।
ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আব্দুল খালেক একজন অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ও আলোকিত মানুষ। তিনি মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত মানব সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম প্রকৌশলী, সম্পাদক, প্রকাশনা–উদ্যোক্তা এবং দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। একাধারে বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এ দুর্লভ ব্যক্তিত্বের বর্ণাঢ্য জীবনালেখ্য সংক্ষেপে শেষ করা যাবে না। চট্টগ্রামের এ স্বপ্নদ্রষ্টা আমাদের মাঝে আর নেই, ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠে। তার এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি একজন স্বনির্মিত মানুষ ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়। একদিকে রাজপথে বাংলার দামাল ছেলেরা, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু। এই রক্তচক্ষুতে যখন অনেকে তটস্থ, তখন ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখা অমর কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ ছাপানোর মতো দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন এক প্রকাশক–সম্পাদক তার নাম ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক।
পেশাগত জীবন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যে তিনি চট্টগ্রামের প্রতি নানা বঞ্চনা খুব কাছ থেকে দেখেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সরকারের অবহেলা এবং সেই পূর্ব পাকিস্তানের অবহেলিত জনপদ চট্টগ্রামের মানুষের অভাব অভিযোগ তুলে ধরার পাশাপাশি মানুষকে শিক্ষিত এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার জন্য তিনি পত্রিকা প্রকাশনায় আত্মনিয়োগ করেন। এখানকার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে তিনি নিজেকে নিবেদিত করেন। এর পূর্বে ১৯২৯ সালে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক চট্টগ্রাম শহরে প্রতিষ্ঠা করেন পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রির প্রতিষ্ঠান কোহিনূর লাইব্রেরী। ১৯৫০ সালের ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা। তিনি ছিলেন সাপ্তাহিক কোহিনূর–এর সম্পাদক ও প্রকাশক। পরে ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয়ও বহুল প্রচারিত দৈনিক আজাদী। যা আজ সারাদেশে সমাদৃত। ওই সময়ে কোহিনূর প্রেস ও পত্রিকাকে ঘিরে চট্টগ্রামের বুকে গড়েওঠে একটি সৃজনশীল সাহিত্য ও সাংবাদিক গোষ্ঠী। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক আজাদী চট্টগ্রামের বুকে জন্ম দিয়েছেন বহু সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কবি ও গবেষককে–যারা এই পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁর প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা থেকে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবং ড. এনামুল হকের যৌথ গ্রন্থ চট্টগ্রামী ভাষার রহস্যভেদ আরাকান রাজ সভার বাংলা সাহিত্য প্রকাশিত হলে সবত্র সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী, জনদরদী, ফানাফিশ্ শায়খ, সহজ–সরল, নিষ্ঠাবান, ধার্মিক ব্যক্তি আলহাজ্ব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তিনি ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সকলের আদর্শ ব্যক্তি। তাঁর সমকক্ষ মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তিনি শুধু লাইব্রেরি, ছাপাখানা, পত্রিকা, মাদরাসা, খানকা প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি নিজেও একজন সুলেখক, সমালোচক, সংবাদকর্মী হিসেবে সমধিক পরিচিত। মহাকবি স্যার আল্লামা ইকবালকে নিয়ে তাঁর লেখা কবিতার কয়েকটি চরণ :
কবি ইকবাল তুমি দিকপাল বলিয়াছে কতজনে / আমি শুধু রূপ অভিনব, আঁকিয়াছি মনে মনে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো যথাক্রমে : শহীদে কারবালা হযরত হোসাইন (রাঃ), হযরত ইমাম আবু হানিফা (রঃ), বার আউলিয়া, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৩০), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন (১৯৫৭), দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন, শেখে চাঁটগাম কাজেম আলী, নেপোলিয়ান, মৌলানা মোহাম্মদ আলী শওকত আলী, ইতিহাসের শহীদ, নেপোলিয়ান, প্রাথমিক ভূগোল, বিজ্ঞান ও গ্রাম্য জীবন, রচনার প্রথম ছডয়া, উর্দু প্রাউমার, বযয়েস ইংলিশ গ্রামার, ফার্স্ট বুক অব ট্রান্সলেশন, চাইল্ড পিকচার ওয়ার্ড বুক, ব্যাকরণ মঞ্জুষা, তাওয়াফ, ঝলমল (শিশুপাঠ), মুসলিম বাল্য শিক্ষা, সহজ পাঠ (শিশুপাঠ্য) প্রভৃতি।
ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক শুধু চট্টগ্রামের সংবাদপত্র ও আধুনিক মুদ্রণ শিল্প জগতের পথিকৃৎই ছিলেন না তিনি উপমহাদেশের অন্যতম সুফি সাধক হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটি (র.)’র প্রধান খলিফা হিসেবে ধর্মীয়ক্ষেত্রেও একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি সিলসিলাহ ও আলিয়া কাদেরিয়ারও একজন খলিফা ছিলেন। আজ থেকে শত বছর আগে রেঙ্গুন গিয়ে হযরত সিরিকোটি হুজুরের হাতে বয়াত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে নবী বংশের এমন একজন কামেল অলীকে চট্টগ্রামে এনে দেশের হাজার হাজার মানুষকে কাদেরিয়া ত্বরিকায় সম্পৃক্ত হবার সুযোগ করে দেন। তিনি নিজের বাসভবন আন্দরকিল্লার কোহিনূর মঞ্জিলকে সিরিকোটি হুজুরের বাসভবন তথা প্রথম খানকাহ্ হিসেবে চালু করেন। আর এখান থেকে প্রজ্জ্বলিত সুন্নিয়াত ও কাদেরিয়া সিলসিলাহর আলো আজ সমগ্র দেশে পৌঁছে গেছে। চট্টগ্রামে ত্বরিকতের আবাদের ক্ষেত্রে তিনি যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা ক্বেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক নিজের আক্বিদা–বিশ্বাস ও আদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদ–এ মিলাদুন্নবী (দ.)-দিবসেই দৈনিক আজাদী পত্রিকার প্রকাশনার সূচনা করেন। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সাথেও জড়িত ছিলেন এবং মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটিরও কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।
আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নগরের আন্দরকিল্লায় ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক চত্বর প্রতিষ্ঠা করেছে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তন গড়ার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের নামে শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি চালু করা হয়েছে।
শেষ কথা : তিনি একজন স্বনির্মিত মানুষ ছিলেন। ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টলার এই মনীষী সদা হাস্যোজ্জ্বল শুভ্র হাসির সরল প্রাণ মানুষটির মহাপ্রয়াণ ঘটে। চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমীন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট