আমার দেখা একজন সৎ, মানব দরদী ও সাদা মনের মানুষ ছিলেন সদ্য প্রয়াত ডা. জামাল আহমদ স্যার। ভেবে পাই না কী লিখব, কী নিয়েই বা শুরু করব? এটা লিখতে যে আনন্দ হচ্ছে সেটা কোনোভাবেই নয়। কিংবদন্তি চিকিৎসক হয়তো এদেশে অনেকেই রয়েছেন। চরম হতাশা আর বেদনা নিয়ে আজ মনে হলো সদ্য প্রয়াত ডা. জামাল আহমদ স্যার এর কিছু স্মৃতি রোমন্থন করি। মানবিক এই চিকিৎসকের নাম ডা. জামাল আহমদ। যিনি এই পেশায় থেকেও মানব সেবার ব্রত নিয়ে অভিজাত শহরাঞ্চল এর পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে ছুটে যেতেন ফুলের ডেইল নামক নিজ গ্রামে। তাঁর লক্ষ্য ছিল একটাই, গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে সেবা পৌঁছে দেয়া। যা তিনি অনেকাংশেই এর বাস্তব রূপও দিয়েছিলেন নিজ কর্মগুণে। সাধারণ মানুষের কাছে আস্থার প্রতীকও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। টেকনাফ উপজেলার ফুলের ডেইল গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে উনার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তা অভিভূত হওয়ার মতো। তিনি অল্প সময়ে সাধারণ মানুষের মনে এভাবে জায়গা করে নিয়েছেন নিজ যোগ্যতা, মানবিকতায় তা সত্যি দৃষ্টান্তমুলক, অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। ধনী গরীব, নারী–পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ সবার মাঝে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বস্ত বন্ধু। তাই তো তিনি সাধারণ মানুষের কাছে মানবিক ডাক্তার বলে গোটা টেকনাফবাসীর কাছে আলাদা একটা পরিচিতিও পেয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক গুণী ব্যক্তির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। যুগে যুগে কালে কালে যারা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছেন তেমনি বাংলাদেশের চিকিৎসা অঙ্গনে ডা. জামাল আহমদ হলেন আলোকবর্তিকার মতো ও অবিস্মরণীয় একটি উজ্জল নক্ষত্রের নাম। পরিশ্রম, সততা, মেধা, আন্তরিকতা ও অধ্যবসায়ের বলে পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন এক মহীরুহ। অতি অল্পদিনে চলে গেলেন চিকিৎসক সমাজের গর্বের মানুষ বিশাল হৃদয়ের এই মহাপ্রাণ ব্যক্তিটি। এই বিশিষ্ট চিকিৎসক মেধায়, মননে, দক্ষতায়, অত্যন্ত জ্ঞানী, নিরহংকারী ও সহজ সরল ব্যক্তি হিসেবে অতি অল্প সময়ে সকলের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন। ডা. জামাল আহমদ স্যার জন্ম হয় ১৯৫৬ সালের ১৮ই নভেম্বর কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের পানখালী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। তাঁর পিতা মাওলানা আবুল হাশেম সাহেব ছিলেন বিশিষ্ট আলেম, ব্যবসায়ী এবং হ্নীলা জামেয়া দারুস সুন্নাহ মাদ্রাসার প্রথম মোহতামিম। তিনি ছিলেন একজন আধুনিক মনষ্ক বিদ্যোৎসাহী সজ্জন ব্যক্তি। মাতা গুলফরাজ আরা বেগম শুধু গৃহিনীর মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে টেকনাফ উপজেলার প্রথম চিকিৎসক তাঁর সন্তান ডা. জামাল আহমদ–কে সমাজ হিতৈষী হবার সুশিক্ষাটা প্রদান করে গেছেন। ডা. জামাল আহমদ টেকনাফ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, উত্তর হাটহাজারীস্থ নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (১৮তম ব্যাচ) হতে চিকিৎসা বিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। উল্লেখ্য, ডা. জামাল আহমদ টেকনাফ উপজেলার প্রথম এম.বি.বি.এস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকাস্থ জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট থেকে হৃদরোগের উপর উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। ডা. জামাল আহমদ দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি থাকাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, বরিশাল মেডিকেল কলেজ, ঢাকাস্থ হৃদরোগ ইন্সটিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি টেকনাফ উপজেলার পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, ধার্মিক বিজ্ঞান মনষ্ক সচেতন করার মত দুরূহ কাজটি করার প্রয়াস চালিয়ে এসেছিলেন ১৯৯৮ সাল থেকে। সুবিধা বঞ্চিত অসহায় মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন কোমল ও সহানুভুতিশীল। একজন সার্থক ও প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি পেলেও ডা. জামাল আহমদ তাঁর জন্মস্থানের চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত গরীব জনগণের কাছে তাঁর দায়বদ্ধতার কথা ভুলে যাননি। তাই চিকিৎসক হওয়ার পর ছুটিতে বাড়িতে গেলে এলাকার গরীব জনগণ তাঁর বাড়িতে এসে ভীড় করতো চিকিৎসা সেবা কিংবা পরামর্শ নেবার জন্য। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছে, একদিন ডা. জামাল আহমদ কে এলাকার উন্নয়নের জন্য নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিলেন–যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ ডা. জামাল আহমদ একান্ত মনের তাগিদে গড়ে তুলেছিলেন ’হ্নীলা গুলফরাজ হাশেম ফাউন্ডেশন’। তাঁর বাবা–মার সমাজ সেবার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল সমমনাদের নিয়ে সে আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করেছেন। ‘হ্নীলা গুলফরাজ–হাশেম ফাউন্ডেশন’ বৃহত্তর চট্টগ্রামে সমাজ উন্নয়ন প্রচেষ্টার একটি রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। চিকিৎসক হিসেবে ডা. জামাল আহমদ এই পর্যন্ত ভারত, মিশর, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট, চীন, সিঙ্গাপুর, অষ্টেলিয়া ইত্যাদি দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও হৃদরোগ বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান হতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ ডা. জামাল আহমদ এর আমন্ত্রণে তাঁর জন্মভুমিতে বার্ষিক চিকিৎসা ক্যাম্পে গরীব জনগণকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করার জন্য যেতেন। তাঁর মা, বাবার নামে দেয়া গুলফরাজ–হাশেম ফাউন্ডেশন নিয়মিত চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা বৃত্তি, পাঠাগার, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, এবতেদায়ী শিক্ষা হ্নীলার জনগণকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছেন।
এছাড়া ফাউন্ডেশনের উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য বিষয়ক সেমিনার, কর্মশালা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয় মুক্ত আলোচনা, বিভিন্ন স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম (ডায়াবেটিস, কিডনী, যকৃত)। ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে মাতৃমঙ্গল ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, ওয়ার্ড ভিত্তিক মসজিদকেন্দ্রিক, স্যাটেলাইট ক্লিনিক চালুকরণ। মরহুম ডা. জামাল আহমদ পেশা হিসেবে চিকিৎসা শাস্ত্রকে গ্রহণ করে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে সমমনা চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘সি.এস.সি.আর’ ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত সিএসসিআর কার্ডিয়াক এর মতো আধুনিক চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান। একদিকে নিজ গ্রামে ‘হ্নীলা গুলফরাজ–হাশেম ফাউন্ডেশন’ এবং অন্যদিকে চট্টগ্রাম শহরে ‘সি.এস.সি.আর’ ও সিএসসিআর কার্ডিয়াক সদ্য প্রয়াত ডা. জামাল আহমদকে দক্ষ সংগঠক হিসেবে খ্যাতি উপহার দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে হ্নীলা গুলফরাজ–হাশেম ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ডের জন্য ডা. জামাল আহমদ বিভিন্ন সম্মাননাও লাভ করেছিলেন। এগুলো হচ্ছে– সমাজসেবা কার্যক্রমের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক টেকানাফ অঞ্চলের ‘সাদা মনের মানুষ’ স্বীকৃতি লাভ, একুশে টেলিভিশনের ‘দেশজুড়ে’ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সমাজকর্মী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে অংশগ্রহণ এবং সাক্ষাৎকার প্রদান, রাষ্ট্রপতি সচিবালয় থেকে ‘হ্নীলা গুলফরাজ হাশেম ফাউন্ডেশন’ চিকিৎসা, শিক্ষা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অবদানের জন্য ‘প্রশংসা পত্র’, টেকনাফ অঞ্চলের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফোরাম কর্তৃক চিকিৎসা ও সমাজ সেবায় অবদানের জন্য বিশেষ ‘সম্মাননা’, ২০১১ সালে বায়তুশ শরফ আনুজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ কর্তৃক গুণীজন হিসেবে সম্মাননা লাভ, ২০১২ সালে বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক কক্সবাজার জেলার শ্রেষ্ঠ সমাজ সেবক হিসেবেও সংবর্ধিত হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি সরকারি চাকরি ও সামজ সেবার পাশাপাশি গবেষণাধর্মী কাজেও নিয়োজিত ছিলেন। ২০১২ সালে ‘স্বাস্থ্য ও শিক্ষা’ বিষয়ে নিজ গ্রাম হ্নীলার ৫০০ পরিবারের উপর এক গবেষণা কর্ম সম্পন্ন করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর রচিত হৃদরোগ বিষয়ক প্রবন্ধ ও গবেষণা কর্ম বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি হ্নীলা দারুস সুন্নাহ্ মাদ্রাসার মজলিসে সুরার সম্মানিত সদস্য, ও আজীবন সদস্য হিসেবে চট্টগ্রাম কিডনী ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, সন্ধানী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ক্লাব, চট্টগ্রাম শাহীন গলফ ক্লাব এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই দেশ বরেণ্য চিকিৎসক ২০২৪ সালের ১৫ এপ্রিল সোমবার ঢাকাস্থ ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চিকিৎসা জগতের এই মহান মানবিক চিকিৎসকের শূন্যতা কখনও পূরণ হবার নয়। মানবিক এই চিকিৎসক ও নানান গুণে গুণান্বিত মরহুম ডা. জামাল আহমদ উজ্জল ও অসাধারণ কর্মজীবন তাঁকে তাঁর সময়ে একটি জীবন্ত কিংবদন্তী এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি স্মরণীয় নাম হিসেবে উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন আজীবন। তিনি আমাদের কাছে অমর অক্ষয় হয়ে থাকবেন।
লেখক : আইনজীবী, চট্টগ্রাম জজ কোর্ট